রোহিঙ্গাপ্রীতি বিতর্কিত ভূমিকায় দুই সিআইসি

জুলকার নাইন ও আয়ুবুল ইসলাম, কক্সবাজার থেকে ফিরে

রোহিঙ্গা শিবিরগুলো তদারকির জন্য নিয়োজিত সরকারি প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। রোহিঙ্গাদের দেখভাল, ত্রাণকার্য পরিচালনা ও প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার কথা থাকলেও এ ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা অস্পষ্ট। তাদের সামনেই একাধিক বিদেশি এনজিও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনবিরোধী ভূমিকা রাখলেও তা দেখেও না দেখার ভান করছেন তারা। বরং এনজিওগুলোর কথায় ‘উঠবস’ করার মতো অভিযোগও উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে।

এনজিওগুলো রোহিঙ্গাদের চাকরি দেওয়াসহ নানা বেপরোয়া কর্মকান্ডের পর তা গা না করা। সর্বশেষ ৫ লাখ রোহিঙ্গার মহাসমাবেশের অনুমতি দেওয়ার পরও তা স্থানীয় প্রশাসনকে জানাননি এই সরকারি কর্মকর্তারা। বরং মহাসমাবেশ চলাকালে স্থানীয় প্রশাসনের এক কর্মকর্তাকে তার অপেক্ষাকৃত ঊর্ধ্বতন রোহিঙ্গা প্রশাসনের অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এ ধরনের সমাবেশের অনুমতি দিতে হয়। এতে বিদেশিরা খুশি হবে।’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু ২২ আগস্টের প্রত্যাবাসন বা ২৫ আগস্টের মহাসমাবেশ ঘিরেই নয়, গত বছরের ১৪ নভেম্বর প্রত্যাবাসন কার্যক্রমেও সরকারি কর্মকর্তাদের ভূমিকা ছিল এক প্রকার রহস্যজনক। সেই প্রত্যাবাসনকে কেন্দ্র করে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের তেমন কোনো ভূমিকা দৃশ্যমান ছিল না। বরং রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় দীর্ঘদিনের অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়ানোর অভিযোগ আছে এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ত্রাণ বিতরণ ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন টেন্ডার দেওয়া থেকে সুবিধা নেওয়ার পাশাপাশি ক্যাম্পের ভিতরে শত শত দোকান চলতে দিয়ে রোহিঙ্গা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের আর্থিক সুবিধা নেওয়ার কথা ক্যাম্পের সবার মুখে মুখে। এনজিওগুলোর স্বার্থ নিশ্চিত করতে গিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের শাসানো ও ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগও আছে ক্যাম্পের সরকারি প্রশাসনের বিরুদ্ধে। বিতর্কিত কর্মকাে র জন্য দুই ক্যাম্প ইনচার্জকে (সিআইসি) নজরদারি ও দুর্নীতির অভিযোগে এক ক্যাম্প ইনচার্জের (সিআইসি) বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে বিভাগীয় মামলার তথ্য জানিয়েছেন স্থানীয় কর্মকর্তারা।

জানা যায়, দুই বছর আগে রোহিঙ্গা ঢল নামার সঙ্গে সঙ্গে দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনায় একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বাধীন ৬৪ কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন শুরু করেন। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন বা আরআরআরসি অফিস হিসেবে পরিচিত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও ব্যবস্থাপনা প্রশাসনের এসব কর্মকর্তাই দেখভাল করে আসছেন উখিয়া ও টেকনাফের ৩২টি শিবির। সরকারেরর বিভিন্ন সেবা সংস্থা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বেসরকারি সংস্থাগুলোর প্রতিনিধি নিয়ে সমন্বয়ের জন্য প্রত্যেক ক্যাম্পে আলাদাভাবে ক্যাম্প ইনচার্জ (সিআইসি) হিসেবে দায়িত্ব পান উপসচিব পদমর্যাদার সরকারের এসব কর্মকর্তা। একেকটি ক্যাম্পের অর্ধলক্ষাধিক রোহিঙ্গার ক্ষেত্রে সব সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ারও দেওয়া হয় ক্যাম্প ইনচার্জকে। কক্সবাজার জেলা প্রশাসন, উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলা প্রশাসন প্রয়োজনে তাদের সহায়তা করবে কিন্তু কোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না- এটাই সেখানে সাধারণ বিধিনিষেধ।

কিন্তু ১১ লাখ রোহিঙ্গার ব্যবস্থাপনা করতে গিয়ে দেশি-বিদেশি এনজিও এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতায় জড়িয়ে যান সরকারি প্রশাসন আরআরআরসির এসব কর্মকর্তা।

‘ট্রিপল আরসি’ নামে পরিচিত এই রোহিঙ্গা প্রশাসনের কার্যালয়েই নজিরবিহীনভাবে অফিস পায় বেসরকারি সংস্থাগুলোর যৌথ প্ল্যাটফরম ইন্টার-সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপ (আইএসসিজি)। সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে লিয়াজোঁ রক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে নিযুক্ত আইএসসিজির সমন্বয়কারী সেখানে অফিস শুরু করেন।

কক্সবাজারের স্থানীয়দের অভিযোগ, বিদেশি এই সমন্বয়কারীর নির্দেশনাতেই এখন উঠবস করছে সরকারের রোহিঙ্গা প্রশাসন। এ কারণেই এনজিওরা যখন যা চাইছে সেটাই হচ্ছে। তারা প্রত্যাবাসনবিরোধী কাজ করলেও কিছুই বলতে পারছে না বাংলাদেশের সরকারি প্রশাসন। এনজিওরা রোহিঙ্গাদের জন্য কাজের কথা বলে ইচ্ছামতো পাহাড় কাটলেও সেখানে চুপ করে থাকছেন সরকারি কর্মকর্তারা। ক্যাম্পে বিভিন্নভাবে সরাসরি অর্থ বিতরণের মতো কাজ অনিয়মতান্ত্রিক হলেও তার অনুমোদন পাচ্ছে আরআরআরসি থেকে। কোনোভাবেই রোহিঙ্গাদের এনজিওগুলোতে চাকরি দেওয়ার কোনো সুযোগ না থাকলেও কয়েক হাজার রোহিঙ্গা এখন চাকরি করছেন এনজিওগুলোয়। এমনকি বাংলাদেশিদের বাদ দিয়ে সেখানে রোহিঙ্গা নিয়োগের মতো সিদ্ধান্তও অবলীলায় নিচ্ছে এনজিওগুলো। কৌশলে এসব নিয়োগের জন্য অনুমতি নেওয়া হচ্ছে সরকারি প্রশাসন থেকেই।

ক্যাম্পগুলোয় রোহিঙ্গারা প্রকাশ্যে ত্রাণ বিক্রির ব্যবসায় নামলেও কোনো উদ্বেগ নেই সরকারি প্রশাসনের। বরং এর পক্ষে স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে সাফাই গাওয়ার অভিযোগও আছে রোহিঙ্গা প্রশাসনের বিপক্ষে।

জানতে চাইলে এক ক্যাম্প ইনচার্জ এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘অনেক সময় দেখা যায় রোহিঙ্গারা চাল-ডাল বিক্রি করে মাংস কিংবা মাছ খেতে চায়। তাই এ নিয়ে খুব একটা কিছু বলা হয় না।’

উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘সরকারি ও এনজিও কর্মকর্তারা অর্থের লোভে পড়ে বেশি মাত্রায় রোহিঙ্গাবান্ধব হয়ে গেছেন। শিবিরের দায়িত্বে থাকা সরকারি কর্মকর্তারা আশ্রয় শিবিরের ভিতর হাটবাজার বসিয়ে কয়েক হাজার দোকানপাট, জুয়েলারি থেকে লাখ লাখ টাকা আদায় করছেন। এসবের কিছুই সরকারি তহবিলে জমা হয় না।

জানা যায়, গত সপ্তাহে উখিয়া উপজেলা পরিষদে অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা ও উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির মাসিক সভায় রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে নিজেদের চরম উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। এ সময় ক্ষুব্ধ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা পরিস্থিতির জন্য রোহিঙ্গা প্রশাসনকে দায়ী করেন। বলা হয়, ক্যাম্পের দায়িত্বরত কর্মকর্তারা রোহিঙ্গা ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সুবিধাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। এমন চললে প্রত্যাবাসন কোনোভাবেই সম্ভব নয় বলে মন্তব্য জনপ্রতিনিধিদের।

সমাবেশে বিদেশিরা খুশি হবে বলে জানায় আরআরআরসি :
গত ২৫ আগস্ট কুতুপালং ৪ নম্বর শিবিরের বর্ধিতাংশের খোলা মাঠে ৩ থেকে ৫ লাখ লোকের সমাবেশ করতে ২২ আগস্ট লিখিত আবেদন করেন রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ। ক্যাম্পটির ইনচার্জ সিআইসি উপসচিব শামিমুল হক পাভেল সেদিনই অনুমতি দিয়ে দেন। কিন্তু এ বিষয়ে উখিয়া বা কক্সবাজারের স্থানীয় প্রশাসনকে কিছুই জানানো হয়নি। পরে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের জানান, ‘আমাকে সমাবেশ আয়োজনের কথা বলা হয়নি। তবে বিশালসংখ্যক রোহিঙ্গার অংশগ্রহণে সমাবেশের কথা শুনেই আমি আরআরআরসি স্যারের কাছে আমার উদ্বেগের কথা জানাই। জবাবে আরআরআরসি স্যার বলেন, কোনো অসুবিধা হবে না। এ রকম সমাবেশ আয়োজনে বিদেশিরা খুশি হবেন।’

/বাংলাদেশ প্রতিদিন