‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ভাসানচরের প্রচারণা চালালে খবর আছে’

আবদুর রহমান ◑

ভাসানচর পরিদর্শন শেষে রোহিঙ্গাদের ৪০ সদস্যের প্রতিনিধি দল মঙ্গলবার (৮ সেপ্টেম্বর) রাতে কক্সবাজারে নিজেদের ক্যাম্পে ফেরত আসেন। সেখানে অবস্থানকালে ভাসানচর বিষয়ে ইতিবাচক মন্তব্য করেন তারা। তবে বুধবারও (৯ সেপ্টেম্বর) ক্যাম্পে অন্য রোহিঙ্গা সদস্যদের মধ্যে তারা ভাসানচর বিষয়ে কোনও প্রচারণা চালাননি। উল্টো অভিযোগ করেন, ভাসানচর সম্পর্কে কোনও প্রচারণা চালালে তাদের ক্ষতি করা হবে, এমন হুমকি পাচ্ছেন।

বিকালে হুমকি পাওয়ার বিষয়ে জানান টেকনাফের মেরিন ড্রাইভ সংলগ্ন শামলাপুর রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের হেড মাঝি নুর মোহাম্মদ।

তিনি বলেন, “ফোনে আবদুর শুক্কুর ওরফে হুজুর পরিচয়ে হুমকি দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘তুই কে? ক্যাম্প থেকে ভাসানচরে নিয়ে যাওয়াদের তালিকা সরকারকে দেওয়ার দায়িত্ব তোকে কে দিয়েছে? ক্যাম্পে প্রচারণা চালালে তোর খবর আছে, এই দুনিয়ায় বেশি দিন ঠাঁই হবে না। আবার কথা হবে।’ এভাবেই হুমকি পেয়েছি।”

এদিকে সরকার ঘিঞ্জি শরণার্থী শিবির থেকে কমপক্ষে এক লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে মেঘনা নদী ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় জেগে ওঠা ওই দ্বীপে পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে।

মাঝি নুর মোহাম্মদ আরও বলেন, ‘আমার শিবিরের চার জন রোহিঙ্গা নেতা ভাসানচরে ঘুরে এসেছেন। তাদের বিভিন্ন কৌশলে হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে। মঙ্গলবার রাত ১২টার পরে আবদুর শুক্কুর ওরফে হুজুর পরিচয় দিয়ে আমাকে হুমকি দেয়, ভাসানচর নিয়ে ক্যাম্পে কোনও ধরনের প্রচারণা না চালানোর জন্য বলে। যাতে সেখানে কোনও মানুষ না যায়। না হলে পরিণতি ভালো হবে না বলেও জানিয়েছে। তাছাড়া আবার ফোন করবে উল্লেখ করে লাইন কেটে দেওয়া হয়।’

তিনি দাবি করেন, ‘গত বছর রোহিঙ্গাদের ভাসানচর ও প্রত্যাবাসনের সময় সরকারকে যথেষ্ট সহায়তা করেছি। সে সময় স্বেচ্ছায় দেড়শ’ মানুষকে ভাসানচরে যাওয়ার জন্য রাজি করানো হয়েছিল। তখনও এ ধরনের হুমকি ও ঝামেলায় পড়তে হয়েছিল। বর্তমান পরিস্থিতি কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।’

উখিয়ার হাকিমপাড়ার শরণার্থী শিবিরের হেড মাঝি হামিদ হোসেন। তিনি মিয়ানমারের মংডু মেরুল্লাপাড়ার বাসিন্দা। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সেনাদের অভিযানের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। তিনি ভাসানচর দেখতে যাওয়া রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের টিম লিডার ছিলেন।

হামিদ হোসেন বলেন, ‘ভাসানচরের অবকাঠামো ও পরিবেশ সুন্দর। তবে সেখানে থাকার ঘরগুলো নিয়ে আমাদের দ্বিমত রয়েছে। আসার আগের দিন ভাসানচর নিয়ে মতামত চাওয়া হলে সবার পক্ষে থেকে বিষয়টি সেখানকার কর্মকর্তাদের তুলে ধরেছি। ফেরার পর ভাসানচরে যেতে বুধবার পর্যন্ত ক্যাম্পে কোনও ধরনের প্রচারণা চালানো হয়নি। তাছাড়া এখানে আসার পর থেকে বিভিন্ন ধরনের গুজব কানে আসছে। বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের অবহিত করা হয়েছে।’

ভাসানচর ফেরত টেকনাফের জাদিমুরা শরণার্থী শিবিরের হেড মাঝি বলেন, ‘ভাসানচরের অবকাঠামো ও পরিবেশের সম্পর্কে ক্যাম্পে প্রচারণা শুরু করা হয়নি। তাছাড়া ক্যাম্পে সিআইসিরাও এই বিষয় নিয়ে কিছু বলেননি।’

একই কথা বলেছেন ফিরে আসা আরও দুই রোহিঙ্গা নেতা। তবে নাম না বলার শর্তে অপর এক রোহিঙ্গা নেতা বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে মিয়ানমারে জেনোসাইডের শিকার হয়ে বাংলাদেশে এসেছি। যেতে হলে মিয়ানমারে চলে যাবো, ভাসানচরে নয়। আবার অনেকে মনে করেন, তারা এখন মিয়ানমারের কাছাকাছি আছেন। ভাসানচরে গেলে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবো। তাছাড়া অনেকের মাঝে ভয়ও কাজ করছে।’

এর আগে, পরিদর্শনে যাওয়া রোহিঙ্গা নেতারা ভাসানচর থেকে বলেছিলেন, ‘অবকাঠামো এবং সুন্দর পরিবেশ বিষয়ে ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের জানানো হবে। আমাদের চেষ্টা থাকবে, অন্তত প্রতিটি ক্যাম্প থেকে যেন স্বেচ্ছায় কিছু পরিবার ভাসানচরে যেতে রাজি হয়।’

ভাসানচর দেখে ফিরে আসা রোহিঙ্গা নেতারা ক্যাম্পে এখনও প্রচারণা শুরু করেনি বলে জানিয়েছেন টেকনাফের জাদিমুরা ও শালবাগান রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (সিআইসি) মোহাম্মদ খালিদ হোসেন।

শরণার্থী শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারি উচ্চ পর্যায়ের অপর এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ভাসানচর দেখে আসা রোহিঙ্গা নেতাদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে, এমন কথা শোনা যাচ্ছে। বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে খতিয়ে দেখে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ৪০ জন রোহিঙ্গা প্রতিনিধিকে সেনাবাহিনীর মধ্যস্থতায় (৫ সেপ্টেম্বর) গত শনিবার টেকনাফ থেকে ভাসানচরে নিয়ে যায় সরকার। প্রতিনিধি দলটি চট্টগ্রাম হয়ে শনিবার বিকাল ৫টার দিকে ভাসানচরে পৌঁছায়। তাদের জন্য বাংলাদেশ সরকার ভাসানচরে কী ধরনের ব্যবস্থা রেখেছে তা তাদের জানানো হয়। এরপর তাদের (রবিবার ও সোমবার) দুই দিন পুরো আবাসন প্রকল্পের অবকাঠামো ঘুরিয়ে দেখানো হয়। এ সময় তাদের সঙ্গে নৌবাহিনী, পুলিশসহ আরআরআরসি কার্যালয়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। (৮ সেপ্টেম্বর) মঙ্গলবার রাতে তারা কক্সবাজারের ক্যাম্পে পৌঁছান।

প্রসঙ্গত, রোহিঙ্গা স্থানান্তরের জন্য নিজস্ব তহবিল থেকে দুই হাজার ৩১২ কোটি টাকা ব্যয়ে ভাসানচরে আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে সরকার। জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাস থেকে সেখানকার ৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকা রক্ষা করতে ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধ এবং এক লাখ রোহিঙ্গা বসবাসের উপযোগী ১২০টি গুচ্ছগ্রামের অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের এক সভায় ভাসানচরের জন্য নেওয়া প্রকল্পের খরচ ৭৮৩ কোটি টাকা বাড়িয়ে তিন হাজার ৯৫ কোটি টাকা করা হয়। বাড়তি টাকা বাঁধের উচ্চতা ১০ ফুট থেকে বাড়িয়ে ১৯ ফুট করা, অন্যান্য সুবিধা বৃদ্ধিসহ জাতিসংঘের প্রতিনিধিদের জন্য ভবন ও জেটি নির্মাণে খরচ হবে বলে জানা গেছে।