রোহিঙ্গা ফান্ড কমেছে, বিপদের আশঙ্কা

আবু তাহের, সমকাল ◑

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ১১ লাখ রোহিঙ্গার জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্যের পরিমাণ অনেক কমে গেছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে আগামীতে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে বলে আশঙ্কা করছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সদ্য বিদায়ী বছরে ৯২১ মিলিয়ন ডলার সাহায্য প্রত্যাশিত হলেও পাওয়া গেছে ৬৩৫ মিলিয়ন ডলার, যা চাহিদার মাত্র ৬৯ শতাংশ। নতুন বছরে আন্তর্জাতিক সাহায্যের পরিমাণ আরও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ বছর চাহিদা জানানো হয়েছে ৮৭৭ মিলিয়ন ডলার। চাহিদার এই অর্থ জোগান না হলে পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি হবে বলে আন্তর্জাতিক মহলের প্রতি সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে।

কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের জন্য কাজ করছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সমন্বয় সংস্থা ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপ (আইএসসিজি)। সংস্থার সমন্বয় কর্মকর্তা সৈকত বিশ্বাস জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্যের পরিমাণ দ্রুত কমে যাচ্ছে। প্রতিশ্রুত তহবিল পাওয়া যাচ্ছে না। গত বছরে চাহিদার মাত্র ৬৯ শতাংশ পাওয়া গেছে। ফলে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য পরিকল্পিত অনেক ব্যয় সংকোচন করতে হয়েছে। স্থানীয়দের জীবনমান উন্নয়নে নেওয়া অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।

তিনি বলেন, গত বছর ৬৩৫ মিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৫৪০ কোটি টাকার তহবিল পাওয়া গেছে। এই অর্থের সিংহভাগ ব্যয় হয়েছে রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্যসামগ্রী ক্রয়ে। তাদের জন্য চাহিদার ৭৫ শতাংশ খাদ্য, ৬৬ শতাংশ শিক্ষা, ৩৬ শতাংশ স্বাস্থ্য ও পুষ্টির মাত্র ৩৫ শতাংশ পূরণ করা সম্ভব হয়েছে।

সৈকত বিশ্বাস বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্যের পরিমাণ কমে যাওয়ায় আমরা উদ্বিগ্ন। এভাবে প্রতি বছর প্রতিশ্রুত তহবিল কমতে থাকলে আগামীতে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে। এতে স্থানীয়দের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সংঘাত তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আমরা সতর্কবার্তা দিয়েছি। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে দ্রুত প্রত্যাবাসন হওয়ার কথাও বলেছি।

জাতিসংঘের উদ্বাস্তুবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের একটি সূত্র জানিয়েছে, গত বছর ৯ লাখ পাঁচ হাজার রোহিঙ্গাকে মানবিক সাহায্যের আওতায় আনা হয়েছে। এ বছর ওই সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছে আট লাখ ৪০ হাজার। সূত্র জানায়, মানবিক সাহায্যের পরিমাণ কমতে থাকায় অনেক রোহিঙ্গা ক্যাম্প ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। ফলে নতুন জরিপের ভিত্তিতে চলতি বছর প্রায় ৬৫ হাজার কমিয়ে আট লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গার জন্য বাজেট তৈরি করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদের তহবিল নিয়ে উদ্বিগ্ন হলেও স্থানীয়দের জন্য তাদের কোনো উদ্বেগ নেই। রোহিঙ্গা তহবিলের ২৫ শতাংশ স্থানীয়দের জন্য বরাদ্দের প্রতিশ্রুতি থাকলেও খুব সামান্য অংশ তাদের জন্য ব্যয় হয়েছে। গত বছর এক লাখ ৬৫ হাজার রোহিঙ্গা পরিবারের জন্য বিকল্প জ্বালানি এলপিজি সরবরাহ করা হয়। স্থানীয় মাত্র পাঁচ হাজার পরিবারকে ওই সুবিধা দেওয়া হয়েছে। রোহিঙ্গাদের কারণে ব্যাপক পরিবেশ বিপর্যয় হলেও এ ক্ষতি পূরণে আন্তর্জাতিক কোনো সাহায্য-সহযোগিতা নেই। বন বিভাগের পক্ষ থেকে পরিবেশ উন্নয়ন ও সুরক্ষায় ২৯৯ কোটি ২০ লাখ টাকার একটি পরিকল্পনা দেওয়া হলেও তা নিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কোনো বরাদ্দ নেই।

কক্সবাজার বন বিভাগের হিসাব মতে, রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ের জন্য সাড়ে ছয় হাজার একর বনভূমি দখল হয়েছে। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি অকল্পনীয়। পাহাড় কাটায় বদলে গেছে ভূমির প্রকৃতি।

বিভাগীয় বন কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য জ্বালানি কাঠ সংগ্রহে প্রতিদিন বৃক্ষ নিধন হচ্ছে। হারিয়ে যেতে বসেছে এলাকার সবুজ প্রকৃতি। ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার বসবাস ও যাবতীয় কর্মকাণ্ডে প্রভাব পড়েছে আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকায়। নষ্ট হচ্ছে কৃষিভূমি। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় মানুষের বসবাসের অনুপযোগী হবে এ এলাকা।

উখিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গারা ক্যাম্পে ত্রাণসামগ্রী নিচ্ছে। অন্যদিকে ক্যাম্পের বাইরে গিয়ে স্থানীয়দের শ্রম কেড়ে নিচ্ছে। অনেক রোহিঙ্গা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে। তারা বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত রয়েছে। তাদের দ্রুত নিজ দেশে ফেরত পাঠানো না গেলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয়রা কর্মহীন। এলাকার ক্ষয়ক্ষতি ভয়াবহ হলেও স্থানীয়দের জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা নেই। নামমাত্র সাহায্য দিয়ে হোস্ট কমিউনিটির জন্য মায়াকান্না করছে কিছু সংস্থা। এটা কোনোভাবেই মানা যায় না।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক কামাল হোসেন বলেন, রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করা দেশি-বিদেশি সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে আমরা একটি বৈঠক ইতোমধ্যে করেছি। তাদের বলা হয়েছে রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি স্থানীয়দের জন্য তারা যে কাজ করছে, তার একটি প্রতিবেদন স্থানীয় প্রশাসনকে দিতে। এ নিয়ে আগামী সপ্তাহে আরও একটি বৈঠক করা হবে। সংস্থাগুলোর কাছ থেকে প্রতিবেদন পাওয়া গেলে স্থানীয়দের জন্য পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হবে।