রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে বাড়ছে অপরাধ

ডেস্ক রিপোর্ট ◑ যত দিন যাচ্ছে কক্সবাজারের টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে অপরাধ বাড়ছে। এই জেলার টেকনাফ ও উখিয়ার ৩৪টি ক্যাম্পে সরকারি হিসাবেই ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বসবাস করছে। মিয়ানমার থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে পালিয়ে আসা এই বিশাল জনগোষ্ঠী দীর্ঘ সময় ধরে এই এলাকায় থাকতে থাকতে এই অঞ্চলের মানুষের ভাষাও পুরো রপ্ত করে নিয়েছে। ফলে দিনের বেলা তারা অবাধে চলাফেরা করে। স্থানীয় মাদক ও ইয়াবা কারবারি এবং চোরাচালানিদের সঙ্গেও তাদের অবাধ যাতায়াত। আর ক্যাম্পগুলোকে মাদক, ইয়াবা, অস্ত্রের মজুদ বানিয়ে ফেলেছে। অপরাধের মাত্রা বেড়ে এখন রোহিঙ্গাদের মধ্যেই প্রায় প্রতি রাতে ক্যাম্পে সংঘর্ষ চলে।

কয়েকটি সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা থেকে পাওয়া তথ্যমতে, রোহিঙ্গারাই ইয়াবা ও মাদকের বড় বাহক। ইয়াবা ব্যবসায়ীরা সীমান্ত দিয়ে ইয়াবা পাচারের জন্য রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে থাকে। বড় চালান আনার পাশাপাশি ক্যাম্পগুলোতেও ইয়াবা, মাদক বিক্রি হয়।

জানা যায়, সম্প্রতি সিনহা হত্যা ঘটনার পর কক্সবাজারের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি একটু শিথিল হওয়ায় ইয়ারার পাচার বাড়ছে এবং ক্যাম্পে অপরাধও বাড়ছে।

স্থানীয় প্রশাসন এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলেছেন, যত দিন যাচ্ছে রোহিঙ্গারা বেপরোয়া হয়ে উঠছে। মাদক, চোরাচালান, অপহরণ, অস্ত্র ও মানব পাচারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে তারা। সবই তারা স্থানীয়দের মদদে করছে। এখনই নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে রোহিঙ্গাদের জন্য স্থানীয়দের এখানে বসবাস করা কঠিনে হয়ে পড়বে।

জানা গেছে অস্ত্র, মাদক, ধর্ষণ, অপহরণ, বিশেষ ক্ষমতা আইন, পুলিশ আক্রান্ত, ডাকাতি বা ডাকাতির প্রস্তুতি, হত্যা, মানব পাচারসহ বিভিন্ন অপরাধে যুক্ত রয়েছে রোহিঙ্গারা।

উখিয়ার এক জনপ্রতিনিধি বলেন, রোহিঙ্গাদের অবাধ যাতায়াত এবং তাদের যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায় তাহলে দেশ থেকে ইয়াবা নির্মূল অসম্ভব হয়ে পড়বে। অনেক রোহিঙ্গা এখানে বিয়ে করে জায়গা-জমিও নিয়েছে। তারা জানান, বেশ কিছু এনজিও রয়েছে যারা রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরে যেতে নিরুৎসাহিত করছে।

জানা গেছে, গত তিন বছরে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিরুদ্ধে ১২ ধরনের অপরাধে ৭৩১টি মামলা হয়েছে। যাতে আসামি হয়েছে ১ হাজার ৬৭১ জন রোহিঙ্গা। তবে গত বছরের চেয়ে চলতি বছর অপরাধ কিছুটা কমেছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ইকবাল হোসাইন। গত ২৫ আগস্ট পর্যন্ত কক্সবাজার জেলা কারাগারে ৫৫২ পুরুষ ও ৪৮ নারী রোহিঙ্গা বন্দি রয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা কারাগারের সুপার মো. মোকাম্মেল হোসেন।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ইকবাল হোসাইন বলেন অস্ত্র, মাদক, ধর্ষণ, অপহরণ, বিশেষ ক্ষমতা আইন, পুলিশ আক্রান্ত, ডাকাতি বা ডাকাতির প্রস্তুতি, হত্যা, মানব পাচার ও অন্যান্য অপরাধে রোহিঙ্গা অপরাধীদের বিরুদ্ধে গত তিন বছরে ৭৩১টি মামলা হয়েছে। যাতে আসামি হয়েছে ১ হাজার ৬৭১ জন রোহিঙ্গা। এর মধ্যে ৫৩টি খুন, ৪১০টি মাদক, ২৮টি মানব পাচার, ৫৯টি অস্ত্র, ৩৫টি ধর্ষণ, ১০টি ডাকাতি, ১৬টি অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের মামলা উল্লেখযোগ্য।

২০১৭ সালে নানা অপরাধে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ছিল ৭৬টি আর আসামি হয় ১৫৯ জন। ২০১৮ সালে ২০৮ মামলায় আসামি হয়েছে ৪১৪ জন। ২০১৯ সালে মামলার সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২৬৩টি আর আসামি হয় ৬৪৯ জন। চলতি বছরের ২৫ আগস্ট পর্যন্ত রোহিঙ্গা অপরাধীদের বিরুদ্ধে হওয়া ১৮৪ মামলায় আসামি হয় ৪৪৯ জন।

সুশীল সমাজের প্রতিনিধি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গারা ইয়াবার চালানের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে ইয়াবা ব্যবসা বন্ধ করা সম্ভব নয়। ক্যাম্পে কয়েকটি গ্রুপ মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িত। তারা মিয়ানমার থেকে সরাসরি ইয়াবা চালান এনে ক্যাম্পে মজুদ রাখে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়াকড়ির মধ্যেও ক্যাম্পে ইয়াবা চালান, মজুদ এবং লেনদেন করে তারা।

কয়েকজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিঞ্জি এলাকা হওয়ায় অপরাধীরা সেখানে অবস্থান করে। কিন্তু সেখানে যখন তখন অভিযান চালানো সম্ভব হয় না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে। এ সুযোগে ক্যাম্পে ঘটছে অপরাধ কর্মকাণ্ড। অধিকাংশ ক্যাম্প পাহাড় সংলগ্ন হওয়ায় কয়েকটি ডাকাত দলের অপরাধ কর্মকাণ্ডও বেড়েছে। ফলে ক্যাম্প অপরাধীদের জন্য নিরাপদ স্থানে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে ইয়াবা মজুদ ও লেনদেনের জন্য ক্যাম্পগুলো ব্যবহার করছে অপরাধীরা।

কক্সবাজারের ১৬ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক (পুলিশ সুপার) হেমায়েতুল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন কোনো না কোনো ক্যাম্প থেকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের খবর পাওয়া যায়। তবে ক্যাম্পে অপরাধপ্রবণতা বাড়লেও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়নি। রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করছে পুলিশ।

স্থানীয়রা বলেছেন, ক্যাম্পসংলগ্ন পাহাড় ঘিরে ৪-৫টি সংঘবদ্ধ ডাকাত বাহিনী সক্রিয় থাকলেও বর্তমানে ডাকাত জকির আহমদ ওরফে জকির ও আবদুল হাকিম বাহিনী সক্রিয় রয়েছে। ডাকাত জকির ও হাকিম বাহিনী টেকনাফের নাইট্যং পাহাড়, হোয়াইক্যং, উনচিপ্রাং, মিনাবাজার, পুটিবনিয়া, লেদা, জাদিমুরা ও শালবন রোহিঙ্গা ক্যাম্পসংলগ্ন পাহাড়ে অবস্থান করে। তারা মিয়ানমার থেকে ইয়াবা এনে পাহাড় ও ক্যাম্পে মজুদ করে। এরপর দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাচার করে। পাহাড়ে আশ্রয়স্থল বানিয়ে খুন, ডাকাতি, ধর্ষণ, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় অব্যাহত রেখেছে ডাকাত দলগুলো।

বিজিবি জানায়, গত জানুয়ারি থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত ক্যাম্পসহ বিভিন্ন সীমান্তে অভিযান চালিয়ে ৩২ লাখ ৮৬ হাজার ৪০ পিস ইয়াবাসহ ১৩২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ইয়াবা পাচার ও মজুদকালে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয় ১৩ রোহিঙ্গা।

টেকনাফ ২ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. ফয়সল হাসান খান বলেন, সীমান্তে বিজিবি তৎপরতার কারণে ইয়াবা পাচার কিছুটা কমেছে। তবে রোহিঙ্গাদের কারণে ইয়াবা পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এখন ক্যাম্পে মাদক কারবার বেড়েছে। কারণ মাদক ব্যবসায়ীদের জন্য ক্যাম্প এখন নিরাপদ স্থান। তবে মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি অর্জনে বিজিবির টহল অব্যাহত রয়েছে।

আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সূত্রমতে, কক্সবাজারে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ৬৮ জন নিহত হয়েছে। তার মধ্যে ৫১ জন রোহিঙ্গা। তাদের মধ্যে ২৬ জন ছিল সক্রিয় ডাকাত। বাকিরা মাদক কারবারি।

গত দুই বছরে ক্যাম্পের ভেতরে রোহিঙ্গাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে অন্তত ৪৫টি হত্যার ঘটনা ঘটেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে আরও ৩২ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়।

কুতুপালং ক্যাম্পের মাঝি মোহাম্মদ ইসমাইল ও টেকনাফ লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নেতা জাফর আহমদ বলেন, রোহিঙ্গাদের একটি ক্ষুদ্র অংশ অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। তাদের কারণে সাধারণ রোহিঙ্গারা বিব্রত। কিন্তু যারা মাদক পাচারসহ নানা অপরাধ করছে, তাদের সঙ্গে স্থানীয় কিছু লোকজনও জড়িত। যেসব রোহিঙ্গা এসব অপরাধ করছে তারা ক্যাম্পে থাকে না। তবে এটা সত্যি, অপরাধ করার পর অনেকে ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়।

কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা বলেন, রোহিঙ্গারা বেপরোয়া হওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। রোহিঙ্গাদের হামলায় স্থানীয়রাও নিহত হয়েছেন। স্থানীয় বাসিন্দা, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও আক্রান্ত হয়েছেন তাদের হামলায়। এদের দমন করা না গেলে ভবিষ্যতে আরও কঠিন পরিস্থিতির শিকার হবেন স্থানীয়রা।