প্রত্যাবাসনবিরোধীদের হাতে এক বছরে কমপক্ষে ৩২ রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে

রোহিঙ্গা শিবিরে এনজিওগুলোর ‘প্রত্যাবাসনবিরোধী’ কর্মকাণ্ড

তোফায়েল আহমদ, কক্সবাজার ও জাকারিয়া আলফাজ, টেকনাফ :
কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবিরে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) ছদ্মাবরণে বিপুলসংখ্যক লোক রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনবিরোধী অপতত্পরতায় জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। তারা রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরে না যেতে উত্সাহিত করছে। রোহিঙ্গাদের অনেকে মিয়ানমারে ফিরতে আগ্রহী হলেও প্রত্যাবাসনবিরোধী এসব এনজিওর চাপে মুখ খুলতে পারছে না।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রোহিঙ্গা শিবিরে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে যে, কেউ মিয়ানমারে ফিরতে আগ্রহ দেখালেই তাকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের আর খোঁজ মেলে না। প্রত্যাবাসনবিরোধীদের হাতে গত এক বছরে কমপক্ষে ৩২ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। গতকাল বুধবার সরেজমিন রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করেও এমন তথ্য মিলেছে।

প্রত্যাবাসন তালিকায় নাম থাকা উখিয়ার জামতলী শিবিরের এ-ব্লকের এক রোহিঙ্গা বলেন, ‘আশ্রয় শিবিরের সিদ্ধান্ত বাইরের কাউকে জানালেই বিপদ। আশ্রয় শিবিরের এক রোহিঙ্গা নেতার মাধ্যমে জানতে পেরেছি যে প্রত্যাবাসন তালিকায় আমার পরিবারের ছয় সদস্যের নাম রয়েছে। তবে আমরা মিয়ানমারে ফিরে যাব না। কেননা মিয়ানমার আমাদের নাগরিকত্ব ও বসতভিটায় বসবাসের দাবি পূরণ না করতে পারলে সেখানে গিয়ে আমাদের আবারও উদ্বাস্তুর মতো থাকতে হবে।’ তিনি ফিরে যাওয়ার জন্য মিয়ানমারের নাগরিকত্ব, নিজ বসতভূমিতে বসবাসের সুযোগ ও চিকিত্সাসেবা পাওয়ার শর্ত দেন।

ওই শিবিরের আরেক বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘অনিশ্চিত জীবনে আমরা ফিরতে চাই না। প্রত্যাবাসনের আগে আমাদের সুরক্ষার বিষয়টি অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।’

এদিকে গতকাল বুধবার উখিয়ার পালংখালী জামতলী রোহিঙ্গা শিবিরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রোহিঙ্গাদের বেশ কয়েকটি ঘর তালাবদ্ধ। পাশের ঘরের রোহিঙ্গাদের কাছে জানতে চাইলে তারা জানায়, প্রত্যাবাসন তালিকায় নাম রয়েছে জানতে পেরেই সপরিবারে পালিয়ে গেছে ওরা। দেশে ফিরতে গেলেই তাদের ওপর প্রত্যাবাসনবিরোধীরা হামলা চালাতে পারে।

জামতলী শিবিরের এ-ব্লকে এমন ১২টি পরিবার পাওয়া গেছে যাদের ঘরে তালা ঝুলছিল। আশপাশের রোহিঙ্গারা জানায়, রাখাইনে ফেরা এড়াতেই তারা পালিয়েছে। শিবিরের জি-ব্লকেও চারটি ঘরে তালা ঝুলতে দেখা গেছে। ওই ব্লকের বাসিন্দা বনি ইসলাম জানান, প্রত্যাবাসন তালিকায় তাঁর ও তাঁর স্ত্রীর নাম রয়েছে। কিন্তু মা ও ভাই-বোনের নাম নেই। তাঁদের রেখে তিনি যাবেন না। তা ছাড়া মিয়ানমারে ফিরতে তাঁর ভয় হয়।

কালের কণ্ঠ প্রতিবেদককে এনজিওকর্মীর হুমকি : পালংখালী জামতলী রোহিঙ্গা শিবিরে গিয়ে দেখা যায়, ক্রিস্টিয়ান এইড নামের একটি বিদেশি সংস্থার বেশ কিছু কর্মী কয়েকজন রোহিঙ্গাকে সঙ্গে নিয়ে অলিগলি ঘুরে বেড়াচ্ছে ও কথা বলছে। প্রত্যাবাসন তালিকায় ওই রোহিঙ্গাদের নাম রয়েছে। ওই এনজিওকর্মীরা কালের কণ্ঠ প্রতিবেদককে দেখেই ক্ষুব্ধ হন। পরিচয়পত্র, শিবিরে ঢোকার অনুমতি আছে কি না তা জানতে চান তাঁরা।

আশ্রয় শিবিরে দায়িত্বরত সেনাবাহিনীকে পরিচয় নিশ্চিত করে ক্যাম্পে প্রবেশ করা হয়েছে জানালেও ক্রিস্টিয়ান এইডের কর্মীরা বলেন, ‘এখানে ঢুকতে হলে সেনাবাহিনী নয়, ক্রিস্টিয়ান এইডের (সিএইড) প্রধান কর্মকর্তার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আসতে হয়। নয়তো শিবিরে কোনো সাংবাদিক কাজ করতে পারবে না।’ তাঁরা এই প্রতিবেদককে প্রত্যাবাসন তালিকায় নাম থাকা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলতেও নিষেধ করেন।

বাধাদানের বিষয়টি নিয়ে ক্রিস্টিয়ান এইডের কার্যালয়ে তাওহিদুল নামে এক কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তিনি নিয়ে যান তাঁর জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তার কাছে। ওই কর্মকর্তাও বলেন, ‘ক্রিস্টিয়ান এইড ওই শিবির ব্যবস্থাপনার কাজ করে। তাদের অনুমতি ছাড়া সেখানে কেউ ঢুকতে পারে না।’

নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক এক রোহিঙ্গা বলেন, ‘আশ্রয় শিবিরে একেক এনজিওর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একেক রকম কথা বলে। কোনো কোনো এনজিওর কর্মীরা আবার রোহিঙ্গা নেতাদের মাধ্যমে তাদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের চেষ্টা করে।’ সুত্র: কালেরকন্ঠ