শত কোটি টাকার মালিক উখিয়ারঘাট কাস্টমস অফিসের পিয়ন

জনকণ্ঠ •

টেকনাফ কাস্টম্স অফিসে দৈনিক ১৫০ টাকায় মাস্টাররোলে চাকরিজীবী নুরুল ইসলাম ৪৬০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছিল। সম্প্রতি ঢাকার র‌্যাব সদস্যরা তাকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়েছে। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে উখিয়ারঘাট কাস্টমে দৈনিক একশ’ টাকা মজুরির এক পিয়ন কয়েক বছরে শত কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের চমকপ্রদ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

সূত্র জানিয়েছে, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার যোগসাজশে ভুয়া কাগজপত্র ও নিজে নিলামে ক্রেতা হয়ে সরকারী গুদামের লাখ লাখ টাকার আটক পণ্য গোপনে বিক্রয় করে দিয়ে এই বিশাল সম্পদের মালিক বনেছে অবৈধ পিয়ন আবুল হোসেন। সরকারী নিয়ম মতে, গুদামের দায়িত্বে নিয়োজিত ভারপ্রাপ্ত গুদাম কর্মকর্তা ছাড়া আটক পণ্যাদি ভর্তি সংরক্ষিত গুদামের চাবি পিয়নের কাছে থাকতে পারে না মোটেও। সরকারী গুদামে রক্ষিত পণ্য গোপনে বিক্রয় ও নিজের নামে স্বল্পমূল্যে নিলাম দেখিয়ে কাস্টমের এই অবৈধ পিয়ন আবুল হোসেন কোটি কোটি টাকার মালিক ও অঢেল সম্পদের পাহাড় গড়েছে। তার সোনালী ব্যাংক উখিয়া শাখা, রামু রূপালী এজেন্ট ব্যাংক, কোর্ট বাজার ইসলামী ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংক এ্যাকাউন্টে প্রতিসপ্তাহে জমা হয়েছে লাখ লাখ টাকা।

দুদক বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ গত পাঁচ বছরের ব্যাংক হিসাব বিবরণী নেয়া হলে আবুলের কোটি কোটি টাকা লেনদেনের বিষয়টি জানা যাবে বলে সূত্রটি দাবী করেছে।

শুল্কগুদাম সংলগ্ন বসতগৃহের মালিক আনছার উল্লাহ জানান, সরকারী গুদাম থেকে আটক পণ্য চুরি করে জমা করে নিশিরাতে বিক্রি করে দিত পিয়ন আবুল। ঘন ঘন আটক পণ্য চুরি করে আমার ঘরে রাখা এবং সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্বের ক্ষতি হচ্ছে দেখে আমি বিজিবিকে সংবাদ দিই। বিজিবি জওয়ানরা এসে ঘেরাও করে আমার বাড়িটি। পরে উদ্ধার করা হয় গুদাম থেকে চুরি যাওয়া লাখ লাখ টাকার আটক পণ্য।

যাদের মাধ্যমে রক্ষিত গুদামের পণ্য চুরি করে বিক্রয় করা হয়েছিল, তারা বর্তমানে অকপটে স্বীকার করছে পিয়ন আবুল শত কোটি টাকার মালিক বনে যাবার রহস্য। কাস্টমসের পুরনো গুদামটি একটু নড়বড়ে হওয়ায় আটক পণ্যাদি জমা রাখতে পার্শ্বস্থ হাফেজখানা থেকে একটি কক্ষ ভাড়া নেয় উখিয়ারঘাট শুল্কগুদাম কর্মকর্তা। বিভিন্ন সংস্থার আটক পণ্য সেমিপাকা ওই গুদামে নিরাপদে রাখা হয়।

শুক্রবার ওই গুদাম থেকেও লাইলা জুস ও রিস্ক কপিসহ কয়েক লাখ টাকার আটক পণ্য চুরি হয়েছে বলে প্রচার করে পিয়ন আবুলের ব্যবসায়ী পার্টনার পার্বত্য তুমব্রু এলাকার বশির। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে শনিবার (৩ সেপ্টেম্বর) স্থানীয় যুবক মুছা ইব্রাহিমের সঙ্গে বশিরের বাকবিতণ্ডা ও হাতাহাতি হয়।

ওই বশির স্থানীয় মেম্বারের কাছ থেকে ৩ লাখ টাকার পণ্য কিনেছে বলে জানায়। তবে মেম্বার নুরুল আলম বলেন, আমি বশির নামে কারও কাছে নিলামকৃত পণ্য বিক্রি করিনি। এর আগে হাফেজ খানার ভাড়া করা গুদাম থেকেও পণ্য চুরির বিষয়ে দোষারোপ করা হয় মসজিদের ইমাম ও হেফজখানার শিক্ষার্থীদের।

সূত্র জানায়, ছৈয়দ নুর নামে এক ব্যক্তি উখিয়ারঘাট কাস্টমের বাবুর্চি থাকার সুবাদে তার পুত্র আবুল হোসেন ওরফে আবুল এক যুগ আগে কাস্টমের অবৈধ পিয়ন হিসেবে চাকরি নেয়। সরকারীভাবে নয়, তৎকালীন দায়িত্বরত কতিপয় কর্মকর্তা মাসিক তিন হাজার টাকা বেতনে আবুলকে চা-পানি এনে দিতে অবৈধভাবে চাকরিতে নিয়োজিত করেন।

পরবর্তীতে গুদামের চাবি হাতে পেয়ে ঘুষের টাকা ও গুদামে রক্ষিত বিভিন্ন সংস্থার আটক পণ্যাদি গোপনে বিক্রি এবং বদল করে ওই পিয়ন কামাই করেছে কোটি কোটি টাকা।

শুক্রবার রাতে (২ সেপ্টেম্বর) হেফজখানার সেমিপাকা বিল্ডিং গুদাম থেকে আবারও ৯০ হাজার টাকার পণ্য চুরি হয়েছে বলে প্রচার করে পিয়ন আবুল। ইঁদুরে কেটে নষ্ট করেছে দাবী করে অন্তত সাড়ে ছয় হাজার লিটার সয়াবিন তেল গোপনে বিক্রি করে দিয়েছে অবৈধ পিয়ন ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা।

বাকি তেল নিলাম দেয়া হলেও রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে নিজেরা লাভবান হতে নিলামের লট নং-৪/২২ থেকে ৫৮৪ লিটার সয়াবিন তেল সরিয়ে রেখে এসব তেল বিক্রয় করা হয়েছে রামুতে একটি মুদি দোকানে। ইঁদুরে কেটেছে বলে উল্লেখ করে এর আগেও বাইরে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে ৬ হাজার পিস লাইফবয় সাবান।

এখানে মজার বিষয় হচ্ছে-সয়াবিন তেলের বোতল ইঁদুরে কাটেনি, স্ক্যাব বেপারির কাছ থেকে পুরাতন বোতল কিনে এনে গুদামের সম্মুখে রেখে খালি বোতলগুলোর তলা ফুটো করে দেয়া হয়। সেখানে উপরে ঢেলে দেয়া হয়েছে কয়েক লিটার সয়াবিন তেল। তারপর ভিডিও করে দেখানো হয় কাস্টমের সুপার শওকত আলীকে।

পরে কাস্টমের ওই পিয়ন আবুলের মালিকানাধীন জেনুইন এন্টারপ্রাইজ নামে নিলামকারী প্রতিষ্ঠানকে গোপনে সয়াবিন তেল ও সাবানগুলো নিলামে বিক্রয় দেখানো হয়। তেলের বোতল ইঁদুরে কেটেছে মর্মে ভিডিও দেখিয়েছিল সত্যতা স্বীকার করে কাস্টম সুপার শওকত আলী বলেন, তৎক্ষণাৎ বিষয়টি জানলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা সহজ হতো। তারপরও পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ হলে আমরা তদন্ত করে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেব।

কাষ্টম সুপার বলেন, ভারপ্রাপ্ত গুদাম কর্মকর্তা কোথাও গেলে গুদামের তালা সিলগালা অবস্থায় রাখার নিয়ম রয়েছে। তবে আশ্চর্য হলেও সত্য, সরকারী গুদামের চাবি থাকে ওই পিয়ন আবুলের হাতে। উখিয়ারঘাট কাস্টমস গুদাম কর্মকর্তা অজিত প্রসাদ রুদ্র পিয়নের হাতে চাবি থাকার বিষয়টি সত্য জানিয়ে বলেন, বালুখালীতে রাত্রি যাপন বা থাকার পরিবেশ নেই।

বাড়ীঘরে বা কোথাও গেলে ওই সময় বিজিবি জব্দকৃত পণ্য আনলে গুদামে ঢোকানোর জন্য পিয়নের হাতে চাবি রাখা হয়। তবে গুদাম কর্মকর্তা পিয়নের হাতে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে প্রতিরাতে কর্মস্থলের বাইরে থাকেন, তা উর্ধতন কর্তৃপক্ষ জানেন না মোটেও। সুপার শওকত আলী আরও বলেন, কাস্টমের কোন কর্মচারী নিলামে অংশগ্রহণ করতে পারে না।

জেনুইন এন্টারপ্রাইজ নামে লাইসেন্সটির নিলামে পণ্য ক্রেতা কে? তা খতিয়ে দেখা হবে। লাখ লাখ টাকার পণ্য গোপনে বিক্রি করে স্বল্পমূল্যে নিলাম দেখিয়ে উখিয়ার ঘাট শুল্ক গুদামের লট নং-৯/২০, ১/২১, ৭/২১, ৮/২১, ১০/২১ ও ৪/২২ সহ অসংখ্য ডেলিভারি চালান জেনুইন এন্টারপ্রাইজের নামে কাস্টমের ফাইলে জমা রয়েছে। বিভাগীয় অফিসে জমা করা অতীতের রেকর্ডগুলো খতিয়ে দেখা হলে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে বলে জানান নিলামকারীদের অনেকে।

বাবুর্চির ছেলে যার নুন আনতে পান্তা ফুরোয়-১০০ টাকা বেতনে চাকরিজীবী আবুলের শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে স্থানীয়রাও অবাক হয়ে গেছেন। এসব অভিযোগ সত্য নয় দাবী করে আবুল হোসেন বলেন, স্থানীয় এক ব্যক্তির সঙ্গে জমি সংক্রান্ত বিরোধ থাকায় তিনি এসব ষড়যন্ত্র করছে।