শীতে সাগরপথে মানবপাচার বাড়ার শঙ্কা, টার্গেট রোহিঙ্গা

কালের কন্ঠ : আসছে শীত মৌসুমে কক্সবাজারের সাগর উপকূল দিয়ে মালয়েশিয়ায় মানবপাচারের আশঙ্কা বাড়ছে। গত ১০ মাসে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সাগরপথে মালয়েশিয়াগামী অর্ধসহস্রাধিক রোহিঙ্গাকে আটক করে। তবে সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার এক অভিযানেই বঙ্গোপসাগর থেকে ১১৮ জন রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করেছে কোস্ট গার্ড। শীত মৌসুমে সাগর অপেক্ষাকৃত শান্ত থাকায় পাচারকারীরা এ সময় বেছে নেয় বলে জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, স্থানীয়দের মধ্যে অবৈধভাবে সাগরপথে বিদেশ যাওয়া নিয়ে অনীহা তৈরি হওয়ায় এখন পাচারকারীরা উখিয়া ও টেকনাফের ক্যাম্পগুলোতে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের টার্গেট করেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের অবৈধ পাসপোর্ট করার ব্যাপারে কড়াকড়ি করায় আগ্রহীরা এখন সাগরপথ বেছে নিচ্ছে। ফলে প্রতিটি ক্যাম্পেই এখন সক্রিয় রয়েছে তাদের দালালরা। তারা রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে সাগরপথে মালয়েশিয়া পাড়ি জমাতে আগ্রহী করে তুলছে।

এর আগে একাধিক সময় টেকনাফ সাগর উপকূল দিয়ে মালয়েশিয়ায় মানবপাচার চলছিল। তবে সে সময় রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি স্থানীয় বাংলাদেশি মানুষের সংখ্যাও কম ছিল না। পাশাপাশি পাচার কাজে যুক্ত ছিল স্থানীয় কিছু দালালও। তবে এখনকার সময়ে স্থানীয় বাসিন্দারা সাগরপথে ঝুঁকি নিয়ে আর মালয়েশিয়া যাচ্ছে না। তাই দালালরা সুযোগ কাজে লাগাতে এবার টার্গেট করেছে রোহিঙ্গাদের।

সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার দুপুরে সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় সেন্ট মার্টিনসের অদূরে দক্ষিণ বঙ্গোপসাগর থেকে ১১৮ জন রোহিঙ্গা নাগরিককে উদ্ধার করে কোস্ট গার্ড। এ সময় ট্রলারে থাকা চারজন পাচারকারী দালালকে আটক করা হয়। উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে ১৫ জন শিশু, ৫৯ জন নারী ও ৪৪ জন পুরুষ রয়েছে। উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গাদের সবাই উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পের বাসিন্দা।

সেন্ট মার্টিনস কোস্ট গার্ড স্টেশন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জোসেল রানা কালের কণ্ঠকে বলেন, সেন্ট মার্টিনসের অদূরে সাগরে ওই ট্রলারটি ইঞ্জিন বিকল হয়ে ভাসছিল। টহলরত কোস্ট গার্ড সদস্যরা ট্রলারটি দূর থেকে লক্ষ্য করে দ্রুত সেখানে পৌঁছেন। তাঁরা ট্রলারে থাকা মালয়েশিয়াগামী ১১৮ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করেন এবং চারজন দালালকে আটক করা হয়। জোসেল জানান, উদ্ধার হওয়া রোহিঙ্গা নাগরিকদের থানায় হস্তান্তর করে প্রয়োজনীয় আইনি প্রক্রিয়া শেষে নিজ নিজ ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছে।

উদ্ধার হওয়া উখিয়া কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নারী কুলসুমা বেগম বলেন, ‘মালয়েশিয়াতে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। দুই পরিবার মিলে আমাকে স্বামীর কাছে পাঠানোর জন্য ট্রলারে তুলে দিয়েছেন। আমাকে বলা হয়েছিল জাহাজে করে নেওয়া হবে, তবে এখানে এসে দেখি কাঠের ট্রলারে করে পাঠানো হচ্ছিল।’

পুলিশের তথ্য মতে, গত ১০ মাসে সাগরপথে ট্রলারে চেপে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় এ পর্যন্ত ৫৭০ জনকে উদ্ধার করেছেন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। তাদের সবাই বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা। এদের মধ্যে পুরুষদের পাশাপাশি রোহিঙ্গা যুবতি ও শিশুরাও ছিল।
সরেজমিনে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে জানা যায়, সাগরপথে মালয়েশিয়াগামী রোহিঙ্গাদের মধ্যে রোহিঙ্গা সুন্দরী তরুণীর সংখ্যা বেশি। মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত রোহিঙ্গা যুবকদের সঙ্গে বিয়ে দিতে দালালরা তাদের বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে সেখানে নিয়ে যেতে চাচ্ছিলেন। এ ছাড়া অনেক বিবাহিত নারী তাঁদের শিশু-সন্তানসহ সেখানে স্বামীর কাছে যাওয়ার জন্য দালালদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন।

উখিয়ার জামতলী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা ছাবের আহমদ বলেন, যাঁরা দালালদের মাধ্যমে বাংলাদেশি পাসপোর্ট করাতে পেরেছেন তাঁরা বাংলাদেশি সেজে আকাশপথে মালয়েশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিচ্ছেন। কিন্তু সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট করা নিয়ে কড়াকড়ি হওয়াতে অনেকে সাগরপথে ঝুঁকি নিয়ে মালয়েশিয়া যেতে রাজি হচ্ছেন।

তিনি বলেন, প্রতিটি ক্যাম্পে মালয়েশিয়া পাচারকারী দালালচক্রের সদস্যরা কাজ করছেন। তাঁরা প্রথমে কম টাকায় মালয়েশিয়া পৌঁছে দেওয়ার কথা বললেও পরে সেখানে গিয়ে স্বজনদের হাতে পৌঁছিয়ে দেওয়ার আগে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করেন। টাকা দিতে ব্যর্থ হলে বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের পথ বেচে নেয়।

টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা শেফায়েত উল্লাহ বলেন, সাগরপথে মালয়েশিয়া পাচারকারী রোহিঙ্গা দালালদের সঙ্গে এ দেশের স্থানীয় কিছু ব্যক্তিও সম্পৃক্ত রয়েছে। শীত মৌসুমে সাগর অনেকটা শান্ত থাকে, তাই দালালরা মানবপাচারের জন্য আসছে শীত মৌসুমকে কাজে লাগাতে তৎপর হয়েছে।

টেকনাফে র‍্যাব-১৫ সিপিসি-১-এর কম্পানি কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মির্জা শাহেদ মাহতাব বলেন, মানবপাচারকারী দালালরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নাগরিকদের টার্গেট করে নতুন করে সাগরপথে মানবপাচারের চেষ্টা চালাতে পারে। এ কারণে তাদের অপতত্পরতা রোধ করতে এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্পভিত্তিক দালালদের ধরতে প্রতিটি ক্যাম্পে র‍্যাবের নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। যেকোনোভাবে সাগরপথে মানবপাচার ঠেকাতে র‍্যাব সর্বোচ্চ সতর্ক রয়েছে।