কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে ‘ভয়ঙ্কর দৈত্য’

কক্সবাজার প্রতিনিধি •

পরিত্যক্ত প্লাস্টিক বর্জ্য দিয়ে এটি তৈরি

লোকমুখে কিংবা গল্পের বইয়ে দৈত্য কিংবা দানবের কাহিনি শোনেননি এমন মানুষ নেই বললেই চলে। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতের বালিয়াড়িতে দাঁড়িয়ে আছে ভয়ঙ্কর এক দৈত্য। তবে এটি সত্যিকারের দৈত্য নয়; সৈকতে ফেলা প্লাস্টিক বর্জ্য দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এটি।

কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন সৈকত থেকে সংগ্রহ করা ২০ বস্তা পরিত্যক্ত প্লাস্টিক বর্জ্য দিয়ে এটি তৈরি করা হয়েছে। যার উচ্চতা ৩৮ ফুট এবং চওড়া ১৪ ফুট। এটি বানাতে ব্যবহার হয়েছে চিপসের প্যাকেট, পানির বোতল, ভাঙা বালতি, চেয়ার ও বলসহ নানা ধরনের প্লাস্টিক বর্জ্য।

বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে জেলা প্রশাসন ও ট্যুরিস্ট পুলিশের সহায়তায় দৈত্যটি তৈরি করা হয়েছে। প্লাস্টিক দূষণরোধে জনসচেতনতা তৈরির জন্য এটি সৈকতের সিগাল পয়েন্টে প্রদর্শনের জন্য রাখা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ১৬ জন স্বেচ্ছাসেবক সাত দিন ধরে প্লাস্টিকের দৈত্যটি তৈরি করেছেন। এটি এশিয়ার বৃহত্তম বর্জ্য দৈত্য। এটি প্লাস্টিক দূষণে প্রাণ-প্রকৃতির বিরূপতার সাক্ষ্য দিচ্ছে। সৈকতে ঘুরতে আসা পর্যটক ও স্থানীয়দের প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবহারে সচেতনতা তৈরির জন্য ভিন্নধর্মী এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আগামী ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এটি সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, সৈকতের সিগাল পয়েন্টের বালিয়াড়িতে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল বর্জ্য দৈত্য। দেখতে ভয়ঙ্কর। প্রতীকী হলেও তার গায়ে জড়ানো প্লাস্টিক বর্জ্য দেখে বোঝা যাচ্ছে, প্রতিদিন ধ্বংস করে যাচ্ছে প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য। সৈকতে ঘুরতে আসা যে কেউ প্রথম দেখায় ভয় পেলেও কাছে যেতে তা কেটে যাবে।

বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের প্রধান স্বেচ্ছাসেবী সমন্বয়ক আকরাম হোসেন বলেন, ‘সেন্টমার্টিন ও কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের সৌন্দর্য দেখতে প্রতিদিন সমাগম ঘটে হাজারো পর্যটকের। যারা সৈকতের বালিয়াড়ি ও সাগরের পানিতে ফেলছেন প্লাস্টিক বর্জ্য। এতে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে দূষণ। হুমকির মুখে পড়ছে সামুদ্রিক জীব ও মানবজীবন। প্রাণ-প্রকৃতির দূষণরোধে এবং সচেতনতা সৃষ্টিতে ওসব প্লাস্টিক দিয়ে বর্জ্য দৈত্য তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গত দুই মাস ধরে সেন্টমার্টিন, টেকনাফ ও কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত থেকে সংগ্রহ করা হয় এক হাজার বস্তা প্লাস্টিক বর্জ্য। এসব বর্জ্যের কিছু অংশ দিয়ে ওই বর্জ্য দৈত্য তৈরি করা হয়েছে।’

বর্জ্য দৈত্য তৈরির মূল পরিকল্পনাকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের সাবেক শিক্ষার্থী আবির কর্মকার। ২০ বস্তা পরিত্যক্ত প্লাস্টিক বর্জ্য দিয়ে এই দৈত্য তৈরি করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এসব পরিত্যক্ত বর্জ্য কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন সমুদ্রসৈকত থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। সাত দিন ধরে দিনরাত কাজ করে এই দৈত্য তৈরি করেছি আমরা। এটির উচ্চতা ৩৮ ফুট ও প্রস্থ ১৪ ফুট। আমি, শুভ্র বাড়ৈ, নির্ঝর, সাব্বির, বিদ্যানন্দের আট জন স্বেচ্ছাসেবক ও চার জন কাঠমিস্ত্রি মিলে এটি তৈরি করেছি। মূলত মানুষের কাছে সচেতনতার বার্তা পৌঁছে দিতে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে এটি তৈরি করা হয়। এতে প্লাস্টিক বর্জ্যের পাশাপাশি ব্যবহার করেছি কাঠ, পেরেক ও আঁটাসহ কয়েকটি উপকরণ। এটি এশিয়ার সর্বোচ্চ প্লাস্টিক দৈত্য।’

এদিকে, বৃহস্পতিবার বিকালে বর্জ্য দৈত্য দেখতে সৈকতে ভিড় করেছেন পর্যটকরা। ঢাকা থেকে বেড়াতে আসা জাকির হোসেন বলেন, ‘এটি দৈত্যের মতো ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। এখন থেকে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবহারে সচেতন হবো।’

কক্সবাজার নাগরিক আন্দোলনের সভাপতি নজরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিদিন সৈকতে হাজার হাজার মানুষজন আসেন। হোটেল-রেস্তোরাঁর বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে সমুদ্র। প্লাস্টিক বর্জ্যে বিপন্ন হচ্ছে সামুদ্রিক প্রাণী। মারা যাচ্ছে গভীর সমুদ্র থেকে ডিম পাড়তে আসা মা কচ্ছপ, দ্বীপের চতুর্দিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রবাল-শৈবাল। এ অবস্থায় দ্বীপের প্লাস্টিক বর্জ্য অপসারণে ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। এটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এতে মানুষ প্লাস্টিক দূষণের ভয়াবহতা সম্পর্কে অবগত হবেন।’

এ বিষয়ে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, ‘এই বর্জ্য দৈত্যের মাধ্যমে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন ও জেলা প্রশাসন সমাজকে একটি বার্তা দিতে চায়, তা হলো প্লাস্টিকের বর্জ্য ফেলায় যেভাবে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে, তা ধীরে ধীরে দানবে রূপ নিচ্ছে। পরবর্তীকালে এই দানবই মানবসমাজের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। এটি ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। যাতে মানুষজন সচেতন হতে পারেন।’