সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্য গিলে খাচ্ছে ভাসমান দুই শতাধিক দোকান

শুকলাল দাশ :

  • হকার সমবার সমিতির নামে প্রতিদিন লাখ টাকা চাঁদাবাজি

চট্টগ্রাম নগরীর গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি পর্যটনকেন্দ্রের মধ্যে অন্যতম হল পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত। ছুটির দিনে অবসাদ কাটাতে এখানে সমাগম ঘটে লাখো পর্যটকের। তবে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে পর্যটকদের জন্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ৩০ ফুট ওয়াকওয়ে নির্মাণ করলেও তার পুরোটাই এখন অবৈধ দখলদারদের দখলে। পতেঙ্গার দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের অপার সৌন্দর্য গিলে খেয়েছে অবৈধ দখলদারদের দুই শতাধিকেরও বেশি অবৈধ স্থাপনায় গড়ে তোলা ভাসমান দোকান।

এসব অবৈধ স্থাপনার কারণে পর্যটকদের পা রাখার ঠাঁই নেই পতেঙ্গা সৈকতে। বিনোদন বঞ্চিত নগরবাসীর পরিবার–পরিজন নিয়ে এখানে দু’দন্ড প্রশান্তিতে বসার কোনো উপায় নেই। পুরো সৈকতের সৌন্দর্য গ্রাস করেছে ভাসমান দোকানগুলো। স্থানীয় প্রভাবশালী দুটি চক্র পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত হকার সমবায় সমিতি লি. নামে এসব অবৈধ দোকান বসিয়েছে বলে পুলিশ এবং স্থানীয়দের অভিযোগ। সৈকতের এসব অবৈধ দোকান উচ্ছেদের ব্যাপারে এক সংস্থা আরেক সংস্থার উপর দোষারোপ করেই বছরের পর বছর পার করছে। অবৈধ এসব দোকান আর উচ্ছেদ হয় না।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, এই জায়গাটি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ২০১৪ সালে আউটার রিং রোড নির্মাণের সময় সমঝোতা স্মারকের (এমইও) মাধ্যমে অস্থায়ী লিজ নিয়েছিল। পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হলে আবার জায়গাটি তাদেরকে বুঝিয়ে দেয়ার কথা বলে জানান পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আউটার রিং রোড নির্মাণকালে নগরবাসীর বিনোদনের কথাটি চিন্তা করে পতেঙ্গা সি–বিচও (সমুদ্রসৈকত) নান্দনিক ভাবে সাজিয়ে তোলে। পর্যটকদের বসার ব্যবস্থাসহ রাত্রিকালীন নিরাপত্তার কথাটি বিবেচনা করে পুরো সৈকত এলাকায় নান্দনিক লাইটিংয়ের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। পর্যটকরা সাগরের তীরে বসে সাগরের অপার সৌন্দর্য উপভোগ করবেন এমন ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু প্রশাসনের অবহেলায় কিছুদিনের মধ্যেই এতো সুন্দর পর্যটন এলাকাটি স্থানীয় প্রভাবশালী দখলদাররা ভাসমান দোকান বসিয়ে সমুদ্র সৈকতের পুরো সৌন্দর্যই ম্লান করে দিয়েছে। এখন পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতের তীরে দাঁড়িয়ে আর সাগরের উত্তাল ঢেউ, পড়ন্ত বিকেলে সূর্যাস্ত দেখার কোনো সুযোগ নেই। সি–বিচ এলাকার পুরো সৌন্দর্য অবৈধ দখলদারদের ভাসমান দোকানে গিলে খেয়েছে।

পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতের হারিয়ে যাওয়া সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনতে জেলা প্রশাসন, সিডিএ, র‌্যাব এবং পুলিশের যৌথ উদ্যোগ চেয়েছেন চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজ। যৌথ অভিযানের মাধ্যমেই প্রভাবশালী অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী, পতেঙ্গা থানার ওসি এবং ট্যুরিস্ট পুলিশের ইন্সপেক্টরসহ পর্যটকরা।

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) নগরীর সাগরিকা থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত বঙ্গোপসাগর উপকূলে ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ ‘চিটাগং সিটি আউটার রিং রোড’ নির্মাণ করেছে। সেই প্রকল্পের আওতায় শতকোটি টাকা ব্যয়ে সৈকতের সৌন্দর্যবর্ধনও করা হয়। কিন্তু সৈকতে লাগানো ফুলের গাছ ও বাগান নষ্ট করে তৈরি করা হয়েছে এই দুই শতাধিক দোকান।

সরেজমিন দেখা গেছে, পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত ঘিরে অসংখ্য দোকানপাট গড়ে উঠেছে। যেখানে বিভিন্ন পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা। এসব দোকানে বিক্রি হচ্ছে প্রসাধন সামগ্রী, ঝিনুকের পণ্য, খাবারের দোকান, চটপটি, ফুচকা, পেঁয়াজু, কাঁকড়ার দোকান, আচারের দোকান। মূল সৈকতে এসব দোকান গড়ে ওঠার কারণে হাঁটাচলার জায়গাও নেই পর্যটকদের।

এই ব্যাপারে চট্টগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী (ডিভিশন–১) শওকত ইবনে সাহীদ আজাদীকে বলেন, পতেঙ্গা বিচ এলাকায় যেসব অবৈধ দোকনপাট গড়ে উঠেছে–ওই এলাকাটি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আউটার রিং রোড নির্মাণের সময় ২০১৪ সালে আমাদের সাথে এমইও করে অস্থায়ী লিজ নিয়েছিল। ওই সময় মন্ত্রণালয় টু মন্ত্রণালয় একটা সমঝোতা চুক্তি হয়েছিল। তারা প্রকল্পের কাজ শেষ করে আমাদেরকে বুঝিয়ে দেয়ার কথা। এখনো বুঝিয়ে না দেয়ায় আমরা এখন ওইখানে কিছু করতে পারছি না। সিডিএ এখন আমাদেরকে বুঝিয়ে না দিয়ে তারা লিজ দিতে চাচ্ছে। তারা তো লিজ দিতে পারবে না। কারণ তারা অস্থায়ী মালিকানা। সৈকতসহ আশপাশে এখন অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠেছে বলে আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে। এখন সিডিএ যদি আমাদেরকে তাদের প্রকল্পের কাজ শেষে বুঝিয়ে দেয়–তাহলে আমরা কোনো উদ্যোগ নিতে পারবো।

এই ব্যাপারে পতেঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কবিরুল ইসলাম বলেন, পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত এলাকায় যে সব অবৈধ দোকানপাট গড়ে উঠেছে এগুলো উচ্ছেদের জন্য আমি ডিসি স্যারের মাধ্যমে সিডিএকে চিঠি দিয়েছি। এখন সিডিএ কি উদ্যোগ নিয়েছে সেটা দেখার বিষয়। সিডিএ উচ্ছেদ করবে করবে বলে সময়ক্ষেপণ করছে। গত ৩ মাসে আমি ডিসি স্যারের সহযোগিতায় ৪০ থেকে ৪৫টি দোকান উচ্ছেদ করেছি। এখন আমরা তো সরাসরি দোকান উচ্ছেদ করতে পারি না। এসব অবৈধ দোকান উচ্ছেদ করা আমার একার বিষয় নয়। এখানে প্রশাসনের সহযোগিতা দরকার। ম্যাজিস্ট্রেট দরকার। এখানে দোকানগুলো থেকে হকার

সমিতির নামে চাঁদাবাজির কথা বিভিন্ন সময় আমরা শুনে থাকি, তবে সুনির্দিষ্টভাবে কেউ কখনো বলেনি বা অভিযোগ দেয়নি। এরকম অভিযোগ পেলে আমি সাথে সাথে অ্যাকশনে যাবো। কিসের হকার সমিতি! এসব হকার সমিতির কোনো বৈধতা নেই। এখানে ট্যুরিস্ট পুলিশের একটি বঙ আছে। তাদেরকে কখনো দেখা যায় না। এখানে প্রতি শুক্রবার প্রচুর লোক সমাগম হয়। আমি নিজে উপস্থিত থেকে যারা ভ্রমণে আসেন তাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা তদারকি করে থাকি। যাতায়াত পথে কোনো দোকানপাট বসলে সেগুলো সরিয়ে দিই। পর্যটকদের নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে থাকি। এটি নিয়ে আমাদেরও মাথাব্যথা আছে। এসব দোকান উচ্ছেদের বিষয়ে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের সঙ্গেও আমার কথা হয়েছে। হয়তো শিগগিরই উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হবে।

এই ব্যাপারে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত এলাকায় দায়িত্বরত ট্যুরিস্ট পুলিশের ইন্সপেক্টর ইসরাফিল মজুমদার বলেন, পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত এলাকায় অবৈধভাবে ২০০টির বেশি দোকান গড়ে উঠেছে। এই দোকানগুলো সৈকতের সৌন্দর্য নষ্ট করছে। এই অবৈধ দোকানগুলো নিয়ে আমরা ডাটা বেইস করেছি। ওদেরকে (দোকানদারদের) নিয়ে মিটিংয়েও বসেছি। কেউ কোনো চাঁদাবাজি করছে কিনা তাদেরকে জিজ্ঞেস করেছি। তারা আমাদের কাছে স্বীকার করতে চান না। তবে এখানে নীরব চাঁদাবাজি হয় বলে আমাদের কাছে খবর আছে। আমাদের ট্যুরিস্ট পুলিশের অস্ত্র নেই। আমরা সরাসারি উচ্ছেদ কিংবা অ্যাকশনে যেতে পারি না। এসব অবৈধ দোকান উচ্ছেদের জন্য আমরা সিডিএ এবং জেলা প্রশাসক বরাবরে চিঠি দিয়েছি। তাছাড়া বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সভায়ও বিষয়টি জানিয়েছি। তারা যখন অভিযান পরিচালনা করবে তখন আমরা সহযোগিতা করবো।

পর্যটকদের সাথে কথা হলে তারা অভিযোগ করে বলেন, সিডিএ যখন এটিকে নান্দনিক ভাবে সাজিয়ে তুলেছিল–তখন কোনো দোকানপাট ছিল না। কিন্তু কিছুদিন পার হতে না হতেই পুরো এলাকাটি অবৈধ দোকানে ছেয়ে গেছে। এখন বসার এবং হাঁটার জায়গা পর্যন্ত নেই। সমুদ্র সৈকতে যত্রতত্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। এসব অবৈধ দখলদারদের কারণে সৌন্দর্য হারিয়েছে সৈকত। এ সৈকতের নিয়ন্ত্রণকে ঘিরে গড়ে উঠেছে একটি চক্র। দুটি সংগঠনের ব্যানারে এসব দোকান থেকে ১০০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করা এবং দোকানগুলো বসানোর সময় ১০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করার এবং প্রতিদিন হকার সমিতির নামে লাখ টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগ আছে।

স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে পতেঙ্গা থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত আউটার রিং রোড নির্মাণ করে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের পাশাপাশি প্রায় পাঁচ কিলোমিটার বিচ এলাকাজুড়ে নতুন রূপ দেওয়া হয়। এর ফলে শুরুতেই দৃষ্টিনন্দন হয়ে ওঠে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত।

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের এই প্রকল্পটির মাধ্যমে পতেঙ্গা হয়ে উঠে শহরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট। শুরুতেই প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এই পর্যটন স্পটে গিয়ে রাতের বেলায়ও সময় কাটাতেন। শুধু দিনেই নয়, গভীর রাতেও অসংখ্য মানুষ সাগর পাড়ে সময় কাটাতে যেতো। এরই মধ্যে সমুদ্র সৈকতে চোখ পড়ে স্থানীয় অবৈধ দখলদারদের। তারা অবৈধ দোকানপাট নির্মাণের মাধ্যমে বিচ এলাকার সৌন্দর্য নষ্ট করে ফেলে। বিশেষ করে বিচের রাস্তার পাশের গ্রিন লনগুলোর প্রতিটিতেই গড়ে তুলেছে অবৈধ দোকান। অভিযোগ আছে, ট্যুরিস্ট পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের ছত্রছায়ায় পতেঙ্গা সৈকতে এসব অবৈধ স্থাপনা বসিয়েছে এলাকার প্রভাবশালীরা।