“সুফল”প্রকল্পে “কুফল”!

জাহিদুর রহমান:
টেকসই বন ও জীবিকা বা সাসটেইনেবল ফরেস্ট অ্যান্ড লাইভলিহুড (সুফল) প্রকল্পে কাঙ্ক্ষিত সুফল আসছে না। প্রকল্পটির লক্ষ্য ছিল বনকেন্দ্রিক জনগোষ্ঠীর বননির্ভরতা কমিয়ে আর্থসামাজিক উন্নয়ন ঘটানো, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ, বৃক্ষাচ্ছাদন বৃদ্ধি এবং টেকসই বন ব্যবস্থাপনা। কিন্তু প্রকল্পের উদ্দেশ্য সম্পর্কে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের স্পষ্ট ধারণা না থাকায় নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক বন।

পরিবেশবিদদের আশঙ্কা, অবশিষ্ট বন ও বনের জীববৈচিত্র্যের জন্য এ প্রকল্পই কাল হয়ে উঠছে। সেখানে দীর্ঘদিন ধরে বসবাসরত জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে আদিবাসী সমাজের জীবন-জীবিকা ও আবাসন এ প্রকল্পের কারণে আরও বিপন্ন হতে পারে। অবশ্য সরকার বলছে, বনায়ন বাড়াতেই এ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। কোনো গাছ কাটা হচ্ছে না। কেউ উচ্ছেদও হবে না।

তবে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা বনে গাছ লাগাতে গিয়ে অন্য গাছ ধ্বংস করছেন। কোথাও কোথাও আদিবাসীদের লাগানো সবজি ক্ষেত নষ্ট করা হচ্ছে। এতে প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

সুফল প্রকল্পে যা আছে: ২০১৮ সালের ১ জুলাই থেকে ৫ বছর মেয়াদি বন অধিদপ্তরের সুফল প্রকল্প ২০২৩ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা। এক হাজার ৫০২ কোটি টাকার এ প্রকল্পে সরকার ৩২ কোটি ৭২ লাখ টাকা অর্থায়ন করছে। বাকি টাকা ঋণ দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। এর আওতায় আছে পাঁচটি বনাঞ্চল এবং আট বিভাগের ২৮ জেলার ১৬৫টি উপজেলার ৬০০ গ্রাম। প্রকল্পের উদ্দেশ্য অনুযায়ী বৃক্ষ উজাড় হওয়া প্রাকৃতিক বনগুলোর খালি জায়গা, রাস্তার ধার ও নতুন চরে গাছ লাগানোর কথা। প্রকল্পের আওতায় বনায়ন ও বন্যপ্রাণীর নিরাপদ আবাসন, বিপন্ন বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ, বিপন্ন প্রজাতির গাছপালার তালিকা তৈরি ও বননির্ভর পরিবারগুলোর আর্থসামাজিক উন্নয়ন ঘটানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর মাধ্যমে দেশের জাতীয় বনাঞ্চল ১ দশমিক ৫ শতাংশ বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।

প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতি: সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) গত জুন মাসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাঁচ বছর মেয়াদি ‘সুফল’ প্রকল্পটির তিন বছরে আর্থিক অগ্রগতি মাত্র ১৬ শতাংশ। নির্ধারিত সময়ে কাজ শুরু না হওয়ায় অগ্রগতি থমকে আছে। প্রতিবেদন মতে, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি করতে ১০ মাস দেরি হওয়ায় অগ্রগতিও দেরিতে আসছে।

সরকারি প্রতিবেদনে সুফল প্রকল্প: পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনে সুফল প্রকল্পের কিছু অসংগতি তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, প্রকল্পে বনজ সম্পদের ওপর নির্ভরশীল ৪০ হাজার জনগোষ্ঠীর বিকল্প কর্মসংস্থানের কথা থাকলেও এ কার্যক্রম শুরু হয়নি। প্রকল্পভুক্ত এলাকায় বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে কিছুটা অগ্রগতি দেখা গেলেও পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে না। ৭১ শতাংশ গাছ লাগানো হলেও এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য শর্তগুলো মানা হয়নি। শর্ত ছিল- শাল, গর্জন, সোনালু, লটকন, নাগেশ্বর, বন আমড়া, খাড়াজোড়া, গামার, নেওড়, কুম্ভি কানাইডাঙ্গা, জলপাই, কদম, জামসহ বিভিন্ন গাছের চারা লাগাতে হবে। কিন্তু লাগানো হয়েছে অন্য গাছ। তাছাড়া এসব গাছের চারার ৪০ শতাংশও প্রথম বছরেই মারা গেছে।

দ্বিতীয় বছরে কম্পোস্ট সার দেওয়ার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। এক কিলোমিটার এলাকার চারাগাছ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলার তথ্যও উঠে এসেছে পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে। প্রকল্পের শর্তানুযায়ী চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের কিছু বনাঞ্চলে ৫৭৯০ হেক্টর বনায়ন করার কথা। কিন্তু সেখানে পরিচর্যার অভাবে মারা গেছে ২০-৪০ শতাংশ চারা। মাঠ পর্যায়ে প্রতিনিয়ত অংশগ্রহণমূলক পরিবীক্ষণ করার কথা থাকলেও তা হচ্ছে না।

পরিবীক্ষণ চলার সময় পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির ১৯তম সভার আলোচ্যসূচির বাস্তবায়ন অগ্রগতির প্রতিবেদন চাওয়া হলেও তা দেওয়া হয়নি। প্রকল্পের কার্যক্রম পরিদর্শন করে আইএমইডি যে সুপারিশ করেছিল, তা এক মাসের মধ্যে জানানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। যা মানা হয়নি। প্রতি তিন মাস পরপর প্রজেক্ট স্টিয়ারিং কমিটি (পিএসসি) ও প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্ট কমিটির (পিআইসি) সভা হওয়ার কথা থাকলেও তিন বছরে মাত্র দুটি করে সভা হয়েছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রথম বছরে কোনো অডিট আপত্তি না থাকলেও দ্বিতীয় অর্থবছরে ১৩টি আপত্তি এসেছে। আপত্তি সংশ্নিষ্ট অর্থের পরিমাণ দুই কোটি টাকারও বেশি।

উচ্ছেদ আতঙ্কে বনজীবী: ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইলের মধুপুর ও গাজীপুর জেলাজুড়ে বিস্তৃত শালবনও সুফল প্রকল্পের আওতাধীন। তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, ঝোপঝাড় পরিস্কার করে চারা লাগানোর ফলে আবাসস্থল হারিয়ে পশুপাখিও আশ্রয় নিয়েছে লোকালয়ে। প্রকল্পের মাধ্যমে শুধু গজারি গাছের নিচে লাগানো হয়েছে এক লাখ পেয়ারা, লটকন, গর্জনসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা। স্থানীয়দের আশঙ্কা, প্রাকৃতিক বন ধ্বংসের উদ্দেশ্যেই এভাবে এসব গাছ লাগানো হয়েছে।

বাংলাদেশ গারো ছাত্র সংগঠনের (বাগাছাস) কেন্দ্রীয় সভাপতি জন জেত্রা বলেন, খালি জায়গায় গাছ লাগানোর কথা থাকলেও সুফল প্রকল্পের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা তা মানছেন না। শালগাছের নিচে কোদাল চালিয়ে যখন অন্য গাছ লাগানো হয়, তখন শালবৃক্ষের প্রাকৃতিক প্রজনন বিঘ্নিত হয়। প্রাণ হারায় লতাগুল্ম। এভাবে সুফল প্রকল্প চললে জীববৈচিত্র্য কমে যাবে। বনকে বনের মতোই বেড়ে উঠতে দেওয়া উচিত।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক ফারহা তানজীম তিতিল বলেন, সুফল প্রকল্পের পাঁচ বছরের মধ্যে তিন বছর শেষ হয়ে গেলেও ৪০ হাজার বনবাসী মানুষের কর্মসংস্থানের জন্য কোনো পদক্ষেপই নেওয়া হয়নি। সবচেয়ে বড় সমস্যা রয়েছে প্রকল্পের ধারণাগত দিকটিতেই। বনের শিশুরা বন সংরক্ষণ শিখতে শিখতে বড় হয়, অথচ তাদের জন্য বনের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর পরিকল্পনার কথা বলা হচ্ছে। যদিও দরকার ছিল তাদের বন দেখাশোনা করতে বাধা না দিয়ে উৎসাহিত করা। বন ও বনজীবীদের নিয়ে গবেষণায় যুক্ত এ শিক্ষক বলেন, নাগরিক প্রশিক্ষণার্থী এবং বিশেষজ্ঞরা কখনোই বনবাসী মানুষের চেয়ে বনকে বেশি বুঝতে পারবে না। সুফল প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বন বিভাগ বনবাসীদের ফসল কেটেছে, শ্মশান দখল করেছে- এমন অসংখ্য ঘটনা আমরা জানি। বন সংরক্ষণের নামে তারা বন্যপ্রাণীর চলাচলকেও বিঘ্নিত করে চলেছে।

শেরপুর জেলার শ্রীবরদী উপজেলার বালিজুরী এলাকার গারো পাহাড়ের ঢালে খ্রিষ্টানপাড়ায় একটি কুঁড়েঘরে বাস করেন শারীরিক প্রতিবন্ধী ফৈমনি চিরান (৪০)। পরম যত্নে ঘরের পাশে বরবটি চাষ করেছিলেন তিনি। কিন্তু বন বিভাগের কর্মকর্তারা এসে তার স্বপ্নের বাগান মুহূর্তেই কেটে ধ্বংস করে দিয়ে গেছেন। শুধু ফৈমনি নয়, একইভাবে ওই এলাকার সোভিতা ম্রির সুপারি বাগানের ১০০ সুপারি গাছ ও আরও তিনটি পরিবারের চাষ করা লাউ, বরবটি ও করলার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। খ্রিষ্টানপাড়ার বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, বন বিভাগের তৎপরতায় অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে সেখানকার ৪৭টি পরিবার। বালিজুরী রেঞ্জের বন কর্মকর্তার কার্যালয় ঘেরাও করে তারা ইতোমধ্যে প্রতিবাদও করেছেন এসব ঘটনার।

বিশেষজ্ঞদের মতামত: বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, সারা পৃথিবীতে আদিবাসীদের মতো করে কেউ বন রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারেনি, পারবেও না। অথচ তাদের সম্পৃক্ত না করে প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা গাছ কেটে নতুন গাছ লাগানো হচ্ছে। সামাজিক বনায়নে জাতিসংঘ ও আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী সব নিয়ম মেনে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।

তবে সুফল প্রকল্পের পরিচালক গোবিন্দ রায় বলেন, আমাদের মূল কাজ প্ল্যানটেশনের ৫০ শতাংশ শেষ হয়ে গেছে। করোনার কারণে এনজিও প্যাকেজ, উপকারভোগী চিহ্নিত করাসহ বেশকিছু খাতে টাকা কম খরচ হয়েছে। সব মিলিয়ে পুরো প্রকল্পের ২৩ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। প্রায় ১০ হাজার ২০০ জনবলের বিপরীতে শূন্যপদ রয়েছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার। মাঠ পর্যায়ে কাজ বাস্তবায়নের সক্ষমতাও আমাদের কম।

এ প্রকল্পে বন ধ্বংস ও আদিবাসীদের উচ্ছেদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ১৮টি সমীক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার, মাঠ পরিদর্শন, গবেষণা, প্রশিক্ষণ, বনের তথ্য নেওয়া ও সাধারণ মানুষের চাহিদাসহ সবকিছু নিয়েই নার্সারি করার কাজ শুরু হয়েছে। এ প্রকল্পে বিদেশি প্রজাতির গাছকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। হারিয়ে যাওয়া দেশি গাছকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। ইকো-সিস্টেমকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনাই আমাদের লক্ষ্য। বন্যপ্রাণী রক্ষার জন্যও এ প্রকল্পে কাজ হচ্ছে। এ প্রকল্পে কোনো গাছ কাটা হবে না। বন থেকে কাউকে উচ্ছেদ করা হবে না। কোথাও এমন অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বন পাহারা দেওয়ার জন্য স্থানীয়দের মাসিক ভাতা দেওয়া হবে। এ ছাড়া প্রতি পরিবারকে ৪২ হাজার টাকা দেওয়া হবে। জীবন ও বনকে সমন্বয় করে প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, কিছু জায়গায় আদিবাসীরা বনের জমি অন্যকে ইজারা দিয়েছে। ফলে সমস্যা হয়েছে। সুফল প্রকল্পে কোনো আদিবাসীকে বিরক্ত করা হবে না। তারা উপকারভোগীর তালিকায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাবেন।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, করোনার কারণে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সমস্যা হয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদ আরও বাড়ানো হবে। দেশের ২৫ শতাংশ ভূমিতে বনায়নের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু গাছ লাগানোর জায়গাও নেই। বনের জায়গায় অনেকে বাড়িঘর করেছে। সেখান থেকে উচ্ছেদ তো করতেই হবে। তার পরও প্রকল্প বাস্তবায়নে কোথাও কোনো অসংগতি থাকলে পরিবেশবিদ ও আদিবাসীরা সুপারিশ করতে পারেন। সুপারিশ আমলে নিয়ে যাচাই করে দেখা হবে।
সূত্র: সমকাল অনলাইন