সূরা আল কাসাস (অর্থ, নামকরণ, শানে নুযূল, পটভূমি ও বিষয়বস্তু)

নামকরণ

২৫ আয়াতের (আরবী) বাক্যংশ থেকে সূরার নামকরণ করা হয়েছে । অর্থাৎ যে সূরায় (আরবী) শব্দটি এসেছে । আভিধানিক অর্থে কাসাস বলতে ধারাবাহিকভাবে ঘটনা বর্ণনা করা বুঝায় । এ দিক দিয়ে এ শব্দটি অর্থের দিক দিয়েও এ সূরার শিরোনাম হতে পারে । কারণ এর মধ্যে হযরত মূসার কাহিনী বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে ।

নাযিলের হওয়ার সময়-কাল

সূরা নামলের ভূমিকায় আমি ইবনে আব্বাস (রা) ও জাবের ইবনে যায়েদের (রা) একটি উক্তি উদ্ধৃত করে এসেছি । তাতে বলা হয়েছিল, সুরা শু’আরা, সুরা নামল ও সূরা কাসাস একের পর এক নাযিল হয় । ভাষা, বর্ণনাভংগী ও বিষয়বস্তু থেকেও একথাই অনুভূত হয় যে, এ তিনটি সূরা প্রায় একই সময় নাযিল হয় । আবার এদিক দিয়েও এদের মধ্যে নিকটতম সম্পর্ক রয়েছে যে, এ সূরাগুলোতে হযরত মূসা আলাইহিস সালামের কাহিনীর যে বিভিন্ন অংশ বর্ণনা করা হয়েছে সেগুলো পরস্পর মিলিত আকারে একটি পূর্ণ কাহিনীতে পরিণত হয়ে যায় । সূরা শু’আরায় নবুওয়াতের দায়িত্ব গ্রহণ করার ব্যাপারে অক্ষমতা প্রকাশ করে হযরত মূসা বলেনঃ “ফেরাউনী জাতির বিরুদ্ধে একটি অপরাধের জন্য আমি দায়ী । এ কারণে আমার ভয় হচ্ছে, সেখানে গেলেই তারা আমাকে হত্যা করে ফেলবে । ” তারপর হযরত মূসা যখন ফেরাউনের কাছে যান তখন সে বলেঃ “আমরা কি তোমাকে আমাদের এখানে ছোট্ট শিশুটি থাকা অবস্থায় লালন পালন করিনি? এবং তুমি আমাদের এখানে কয়েক বছর থাকার পর যা করে গেছো তাতো করেছই । ” এ দু’টি কথার কোন বিস্তারিত বর্ণনা সেখানে নেই । এ সূরায় তার বিস্তারিত বিবরণ এসে গেছে । অনুরূপভাবে সূরা নামলে এ কাহিনী সহসা একথার মাধ্যমে শুরু হচ্ছে যে, হযরত মূসা তাঁর পরিবার পরিজনদের নিয়ে যাচ্ছিলেন এমন সময় হঠাৎ তিনি একটি আগুন দেখলেন । এটা কোন ধরনের সফর ছিল, তিনি কোথায় থেকে আসছিলেন এবং কোথায় যাচ্ছিলেন এর কোন বিবরণ সেখানে নেই । এর বিস্তারিত বিবরণ এ সূরায় পাওয়া যায় । এভাবেএ তিনটি সূরা মিলে হযরত মূসা আলাইহিস সালামের কাহিনীকে পূর্ণাঙ্গ রূপদান করেছে ।

বিষয়বস্তু ও আলোচ্য বিষয়

এর বিষয়বস্তু হচ্ছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালাতের বিরুদ্ধে যেসব সন্দেহ ও আপত্তি উত্থাপন করা হচ্ছিল সেগুলো দূর করা এবং তাঁর প্রতি ঈমান আনার ব্যাপারে যেসব ওজুহাত পেশ করা হচ্ছিল সেগুলো নাকচ করে দেয়া ।

এ উদ্দেশ্যে প্রথমে বর্ণনা করা হয়েছে হযরত মূসার কাহিনী” । সুরা নাযিলের সময়কালীন অবস্থা সাথে মিলে এ কাহিনী স্বতষ্ফূর্তভাবেই শ্রোতার মনে কতিপয় সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে দেয়ঃ

একঃ আল্লাহ যা কিছু করতে চান সে জন্য তিনি সবার অলক্ষ্যে কার্যকারণ ও উপায়-উপরকণ সংগ্রহ করে দেন । যে শিশুর হাতে শেষ পর্যন্ত ফেরাউনের রাজরত্বের অবসান ঘটবার কথা, তাকে আল্লাহ স্বয়ং ফেরাউনের গৃহে তার নিজের হাতেই প্রতিপালনের ব্যবস্থা করেন এবং ফেরাউন জানতে পারেনি সে কাকে প্রতিতপালন করছেন । সেই আল্লাহর ইচ্ছার সাথে কে লড়াই করতে পারে এবং তাঁর মোকাবিলায় কার কৌশল সফল হতে পারে ।

দুইঃ কোন বিরাট জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান করে এবং আকাশ ও পৃথিবীতে কোন গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণার মাধ্যমে কাউকে এ নবুওয়াত দান করা হয় না । তোমরা অবাক ইচ্ছো, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোথা থেকে চুপিচুপি এ নবুওয়াত লাভ করেন এবং ঘরে বসে বসে তিনি কেমন করে নবী হয়ে গেলেন । কিন্তু তোমরা নিজেরাই যে মুসা আলাইহিস সালামের বরাত দিয়ে থাকে যে, (আরবী) (৪৮ আয়াত) তিনিও এভাবে পথে চলার সময় নবুওয়াত লাভ করেছিলেন এবং সেদিন সিনাই পাহাড়ের নিঝুম উপত্যকায় কি ঘটনা ঘটে গেলো তা ঘূণাক্ষরেও কেউ জানতে পারলো না । মূসা নিজেও এক সেকেণ্ড আগে জানতেন না তিনি কি জিনিস পেতে যাচ্ছেন । যাচ্ছিলেন আগুন আনতে, পেয়ে গেলেন পয়গম্বরী ।
তিনঃ যে বান্দার সাহায্যে আল্লাহ কোন কাজ নিতে চান, কোন দলবল-সেনাবাহিনী ও সাজ-সরঞ্জাম ছাড়াই তার উত্থান ঘটে থাকে । কেউ তাঁর সাহায্যকারী হয় না । বাহ্যত তার কাছে কোন শক্তির বহর থাকে না । কিন্তু বড় বড় দলবল, সেনাবাহিনী ও সাজ-সরঞ্জাম ওয়ালারা শেষ পর্যন্ত তার মোকাবিলায় ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে যায় । তোমরা আজ তোমাদের ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মধ্যে যে আনুপাতিক পার্থক্য দেখতে পাচ্ছো তার চেয়ে অনেক বেশী পার্থক্য ছিল মূসা আলাইহিস সালাম ও ফেরাউনের শক্তির মধ্যে । কিন্তু দেখে নাও কে জিতলো এবং কে হারলো।

চারঃ তোমরা বার বার মূসার বরাত দিয়ে থাকো । তোমরা বলে থাকো, মূসাকে যা দেয়া হয়েছিল তা মুহাম্মাদকে দেয়া হলো না কেন? অর্থাৎ লাঠি, সাদা হাত ও অন্যান্য প্রকাশ্য মু’জিযা সমূহ । ভাবখানা এ রকম যেন তোমরা ঈমান আনার জন্য তৈরী হয়েই বসে আছো, এখন শুধু তোমাদেরকে সেই মু’জিযাগুলো দেখাতে হবে যা মূসা ফেরাউনকে দেখিয়েছিলেন । তোমর তার অপেক্ষায় রয়েছো । কিন্তু যাদেরকে এসব মু’জিয়া দেখানো হয়েছিল তারা কি করেছিল তা কি তোমরা জানো? তারা এগুলো দেখেও ঈমান আনেনি । তারা নির্দ্বিধায় বলেছিল, এসব জাদু । কারণ তারা সত্যের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও হঠকারিতায় লিপ্ত হয়েছিল । এই একই রোগে আজ তোমরাও ভুগছো । তোমরা কি ঐ ধরনের মু’জিযা দেখে ঈমান আনবে? তারপর তোমরা কি এ খবরও রাখো, যারা ঐ মু’জিযা দেখে সত্যকে অস্বীকার করেছিল তাদের পরিণাম কি হয়েছিল? শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন । এখন তোমরাও কি একই প্রকার হঠকারিতা সহকারে মু’জিযা দাবী জানিয়ে নিজেদের সর্বনাশ ডেকে আনতে চাচ্ছো?

মক্কার কুফরী ভারাক্রান্ত পরিবেশে যে ব্যক্তি হযরত মূসার এ কাহিনী শুনতো তার মনে কোন প্রকার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ছাড়াই আপনা আপনিই একথাগুলো বদ্ধমূল হয়ে যেতো । কারণ সেসময় মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লাম ও মক্কার কাফেরদের মধ্যে ঠিক তেমনি ধরনের একটি দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলছিল যেমন ইতিপূর্বে চলেছিল ফেরাউন ও হযরত মূসা আলাইহিস সালামের মধ্যে । এ অবস্থায় এ কাহিনী শুনাবার অর্থ ছিল এই যে, এর প্রত্যেকটি অংশ সম সাময়িক অবস্থার ওপর আপনা আপনি প্রযুক্ত হয়ে যেতে থাকবে । যদি এমন একটি কথাও না বলা হয়ে থাকে যার মাধ্যমে কাহিনীর কোন অংশটি সে সময়ের কোন অবস্থার সাথে সামঞ্জস্যশীল তা জানা যায়, তাহলেও তাতে কিছু এসে যায় না ।
এরপর পঞ্চম রুকু’ থেকে মূল বিষয়বস্তু সম্পর্কে সরাসরি আলোচনা শুরু হয়েছে । মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মী তথা নিরক্ষর হওয়া সত্ত্বেও দু’হাজার বছর আগের ঐতিহাসিক ঘটনা একেবারে হুবহু শুনিয়ে যাচ্ছেন, অথচ তাঁর শহর ও তাঁর বংশের লোকেরা ভালোভাবেই জানতো, তাঁর কাছে এসব তথ্য সংগ্রত করার জন্য উপযুক্ত কোন উপায় উপকরণ ছিল না । প্রথমে এ বিষয়টিকে তাঁর নবুওয়াতের প্রমাণ হিসেবে গণ্য করা হয় ।

তারপর তাঁকে নবুওয়াত দান করার ব্যাপারটিকে তাদের পক্ষে আল্লাহর রহমত হিসেবে গণ্য করা হয় । কারণ তারা গাফিলতির মধ্যে ডুবে গিয়েছিল এবং আল্লাহ তাদের সৎপথ দেখাবার জন্য এ ব্যবস্থা করেন ।

তারপর তারা বারবার “এই নবী এমন সব মু’জিযা আনছেন না কেন? যা ইতিপূর্বে মূসা এনেছিলেন । ” এ মর্মে যে অভিযোগ করছিল তার জবাব দেয়া হয় । তাদেরকে বলা হয়, মূসার ব্যাপারে তোমরা স্বীকার করছো যে, তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে মু’জিযা এনেছিলেন । কিন্তু তাঁকেই বা তোমরা কবে মেনে নিয়েছিলে? তাহলে এখন এ নবীর মু’জিযার দাবী করছো কেন? তোমরা যদি প্রবৃত্তির কামনা বাসনার দাসত্ব না করো, তাহলে সত্য এখনো তোমাদের দৃষ্টিগ্রাহ্য হতে পারে । কিন্তু তোমরা যদি এ রোগে ভূগতে থাকো, তাহলে যে কোন মু’জিযা আসুক না কেন তোমাদের চোখ খুলবে না ।

তারপর সে সময়কার একটি ঘটনার ব্যাপারে মক্কার কাফেরদেরকে শিক্ষা ও লজ্জা দেয়া হয়েছে । ঘটনাটি ছিলঃ সে সময় বাহির থেকে কিছু খৃষ্টান মক্কার আসেন এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুখে কুরআন শুনে ঈমান আনেন । কিন্তু মক্কার লোকেরা নিজেদের গৃহের এ নিয়ামত থেকে লাভবান তো হলোই না । উপরন্তু আবু জেহেল প্রকাশ্যে তাদেরকে লাঞ্ছিত করে ।
সবশেষে মক্কার কাফেররা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা না মানার জন্য তাদের পক্ষ থেকে যে আসল ওযর পেশ করতো সে প্রসংগ আলোচিত হয়েছে । তারা বলতো, যদি আরববাসীদের প্রচলিত পৌত্তলিক ধর্ম ত্যাগ করে আমরা এ নতুন তাওহীদী ধর্ম গ্রহণ করি, তাহলে সহসাই এদেশ থেকে আমাদের ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নেতৃত্ব খতম হয়ে যাবে । তখন আমাদের অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছুবে যার ফলে আমরা আরবের সবচেয়ে বেশী প্রভাবশালী গোত্রের মর্যাদা হারিয়ে বসবো এবং এ ভূ-খণ্ডে আমাদের জন্য কোন আশ্রয়স্থলও থাকবে না । এটিই ছিল কুরাইশ সরদারদের সত্য বৈরিতার মূল উদ্যোক্তা । অন্যান্য সমস্ত সন্দেহ, অভিযোগ, আপত্তি ছিল নিছক বাহানাবাজী । জনগণকে প্রতারিত করার জন্য তারা সেগুলো সময়মতো তৈরী করে নিতো । তাই আল্লাহ সূরার শেষ পর্যন্ত এর ওপর বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এবং এক একটি দিকের ওপর আলোকপাত করে অত্যন্ত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এমন সমস্ত মৌলিক রোগের চিকিৎসা করেছেন যেগুলোর কারণে তারা পার্থিব ও বৈষয়িক স্বার্থের দৃষ্টিতে সত্য ও মিথ্যার ফায়সালা করতো ।