হজরত ওমর (রা.) কবিতা লিখতেন আবৃত্তিও করতেন

মানব সৃষ্টির শুরু থেকেই কবিতা ছিল। আর আরবের বেদুইনদের জীবন-জীবিকা, স্বপ্ন, বাস্তবতা, আশা, আনন্দ, শুত্রুতা-মিত্রতার বাহন ছিল কবিতা। রাসূল (সা.)ও কবি-কবিতার উর্বর জনপদ মক্কা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। পেয়ারে নবী ও সাহাবায়ে কেরামের যুগের কাব্য সাহিত্য নিয়ে আছে আদিগন্ত বিস্তীর্ণ কথকতা। যা নাতিদীর্ঘ ও বিশদ আলোচনার দাবি রাখে। পেয়ারে নবীর সাহাবায়ে কেরামের প্রত্যেকেই ছিলেন আরবি ভাষায় পারদর্শী ও সাহিত্যমনস্ক। কবিতার ক্ষেত্রে রাসূলের সাহাবিখ্যাত ‘ত্রয়ী’ হাসসান ইবনে সাবিত, আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা ও কাব ইবনে মালিক (রা.)-এর পারঙ্গমতা সাহিত্য মহলে সুবিদিত। প্রধান চার খলিফার তিনজনই সাহিত্যালয়ে ঝলমলে। ইতিহাসের বিভিন্ন বর্ণনানুযায়ী তাদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা কবিতা রয়েছে।

‘আল-উহমাদ’ বইয়ে বিখ্যাত মনীষী ইবনে রশিক লিখেছেন, ‘কাব্য সাহিত্যে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.) তার যুগের শ্রেষ্ঠ সমালোচক ও সূক্ষ্মদর্শী ছিলেন। তিনি কাব্য-সাহিত্যের সমালোচনা ও পর্যালোচনা করতেন।’

কবিতার ক্ষেত্রে হজরত ওমর (রা.)-এর দৃষ্টিভঙ্গি, সমালোচনা ও মতামত ইসলামী সাহিত্যের প্রতিনিধিত্ব এবং সুস্থ চিন্তাধারার রূপায়ণ করে। সাহিত্যকে সুসংহত ও উপাদেয় করতে ওমর (রা.)-এর ভূমিকা ছিল অনেক বেশি। কাব্যচর্চায় তিনি ছিলেন প্রাগ্রসর। তিনি বিভিন্ন সময় রাসূল (সা.)কে কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতেন। তার বক্তব্য ও আলোচনাগুলো ছিল কবিতা ও প্রবাদবাক্যের আবরণে মোড়ানো। অসংখ্য কবিতা তার কণ্ঠস্থ ছিল। অনেক সময় কোনো কিছুর দলিল উপস্থাপন কিংবা প্রমাণ দেয়ার ক্ষেত্রে অথবা জীবনের কোনো অনুঘটনায় কবিতা উল্লেখ করতে ওমর (রা.) ভীষণ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন।

হজরত ওমর (রা.) স্বভাবজাতভাবেই কবিতা চর্চা করতেন। তিনি নিজের কবিতা বারবার মুখে আওড়িয়ে মুখস্থ করতেন। সময়-সুযোগে আবৃত্তিও করতেন। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘ওমর (রা.) থেকে বেশি কবিতা মুখস্থকারী কাউকে আমি দেখিনি।’

এমনিভাবে ইবনুল জাদিয়া বলেন, ‘কোনো কাজ করতে গিয়ে ওমর (রা.) ক্লান্তি ও অবসাদ অনুভব করলে কবিতা আবৃত্তি করতেন। কবিতার সুকুমারবৃত্তি, সদাচরণ, নিষ্ঠা ও মানবিক গুণাবলী চর্চার উৎসাহ দিতেন। কবিতা মুখস্থ করার কথাও বলতেন।’

ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.)-এর কটি কবিতা এখানে তুলে ধরা হল-

আমি যেভাবে কালিমাওয়ালা হলাম

‘আলহামদুলিল্লাহি জি মান নাললাজি ওজাবাত লাহু আলাইনা, আইয়াদা মা লাহা গিয়ার

ওয়া কাদ বাদানা ফাকাজজাবনা, ফাকালা লানা সিদকাল হাদিসি নাবিইয়্যুন ইনদাগুল খবর

ওয়া কাদ জালামতু বিনতা-লখাত্তাবি সুম্মা হাদা রব্বি, আশিয়্যাতা কালু কাদ সাবা ওমর

ও কাদ নাদিমতু আলা মা কানা মিন জালালিন বি জুলমিহা, হিনা তুতলা ইনদাহা সুয়ার

লাম্মা দাআদ রব্বাহা জাল আরশি জাহিদান, ওয়াদ-দুমুয়ু মিন আইনিহা আজলানি ইয়াবতাদির

আইকানতু আন-নাললাজি তাদয়্যুহু খালিকুহা, ফাকাদা তুসবিকনি মিন আরবাতি দুরার

ফাকুলতু আশহাদু আন্না-ল্লাহা খালিকুনা, ওয়া ইন্না আহমাদা ফিনা-লইয়াওমা মুশতাহারা

নাবিয়্যুন সিদকা আতা বি-লহাক্কি মিন সিকাতিন, ওয়া-ফিল আমানাতি মা ফি আওদিহি খায়ার’

ভাবানুবাদ- ‘সব প্রশংসা আল্লাহর, যার শুকরিয়া আদায় করা আমাদের জন্য ওয়াজিব হয়ে গেছে। আমাদের ওপর রয়েছে তার অনেক অনুগ্রহ, যার শুকরিয়া আদায়ে অহংবোধও নেই।

আমাদের মাঝে এসেছেন এক নবী, অথচ অমরা তাকে মিথ্যা দাবি করছি। তিনি আমাদের সত্য কথাই বলেছেন, তিনি এমন নবী, যার কাছে আছে সত্য বাণী।

আমি খাত্তাবের মেয়ের ওপর জুলুম করেছি, এরপর সন্ধ্যাবেলায় আমার আল্লাহ আমাকে হেদায়াত দিয়েছেন। আর তারা বলেছে, ওমর ধর্মত্যাগী হয়েছে।

যখন তার কাছে সূরা তিলাওয়াত করা হচ্ছিল, তখন তার ওপর জুলুম করার মাধ্যমে আমার যে অন্যায় হয়েছে, এ জন্য আমি তার কাছে লজ্জিত।

যখন সে কাকুতি-মিনতির সঙ্গে তার আরশের মালিককে আহ্বান করল, আর দ্রুতগতিতে চোখ থেকে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ল।

আমি নিশ্চিত হলাম, ফাতেমা যাকে ডাকছে তিনিই তার স্রষ্টা। তখন অশ্রুজলের মণি-মুক্তা আমাকেও ছাপিয়ে যাওয়ার উপক্রম হল। পরপরই আমি বললাম, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ আমাদের স্রষ্টা এবং আহমদ তার রাসূল। আমাদের সামনে তিনি প্রসিদ্ধ এক ব্যক্তি।

তিনি সত্য নবী, যিনি সত্যের দাওয়াত নিয়ে এসেছেন নির্ভরযোগ্য সূত্র আল্লাহ থেকে। তিনি সত্যের সেই আমানতকে রক্ষাকারী ও বিশ্বস্ত। তার দাওয়াতে কোনো দুর্বলতা নেই।’

পাপকে ডেকে আনে আরেক পাপ

‘তাওয়াআদনি কাআবুন ছালাছান আয়ুদ্দুহা, ওয়ালা শাক্কা আন্না-লকাওলা মা কালা লী কাআব

ওয়া মা বী হিজারু-লমাওতি ইন্নি লামাইয়্যিতা, ওয়া-লাকিন্না হিজারু-যযানবি ইয়ামবায়ুহু-জানাব’

ভাবানুবাদ- ‘কাআব আমাকে তিন দিনের ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছেন, যা আমি গণনা করছি। আর এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, যথার্থ কথা তাই, যা আমাকে কাআব বলেছেন।

মৃত্যুর ব্যাপারে আমার কোনো ভয় নেই, কেননা নিশ্চয়ই আমি মৃত্যুতে ঢলে পড়ব কিন্তু পাপের ব্যাপারে আমার ভয় আছে, কেননা পাপকে অনুসরণ করে আরও পাপ।’

নিজের প্রতি জুলুমকারী এক মুসলমান

‘জালুমুন লিনাফসি গাইরা আন্নি মুসলিমুন, য়সাললি-সাসাত কুল্লুহা ওয়া আসুমু’

ভাবানুবাদ- ‘আমি আমার নিজের প্রতি জুলুমকারী, তবু আমি মুসলমান। আমি সব নামাজই আদায় করি এবং সবকটি রোজাই রাখি।’

মওতের দরিয়ায় একদিন নামতে হবে

‘লা শাইআ ফিমা তারা তাবকা বাশাশাতুহু, ইয়াবকা-লইলা ওয়া ইয়ুদি-লমাসু ওয়া-লওয়ালাদু

লাম তুগনি আন হুরমুজিন ইয়াওমান খাজাইনুহু, ওয়া-লখুলদু কাদ হাওয়ালাত আদা ফামা খালাদু

ওয়া লা সুলাইমানা ইজ তাজরি-ররিয়াহু বিহি, ওয়া-লইনসু ওয়া-লজিন্নু ফিমা বাইনাহা বুরুদু

আইনা-লমুলুকু-ললাতি কানাত নওয়াফিলুহা, মিন কুললি আওবিন ইলাইহা রাকিবুন ইয়্যুফিদু

হাওজান হুনালিকা মাওরুদান বিলা কাজিবিন, লা বুদ্দা মিন ওয়ারদিহি ইয়াওমান কমা ওয়ারাদু

ভাবানুবাদ- ‘তুমি যা কিছু দেখ, তাতে এমন কিছুই নেই যার সৌন্দর্য বাকি থাকবে। বাকি থাকবেন কেবল এক ইলাহ আল্লাহ। ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে একদিন।

একদিন হুরমুজের ধন-সম্পদ তার কোনো কাজে আসেনি। আর অমরত্ব বল! আদ জাতি তো অমর হতে করেছিল, কিন্তু তারা অমর হয়নি।

নবী সুলাইমানও বেঁচে থাকেননি, অমর হননি। অথচ বাতাস জিন মানুষ পরিষদবর্গ তাকে বয়ে বেড়াত গন্তব্যে, যেখানে থাকত অসংখ্য মানজিল।

আজ সেই বাদশাহরা কোথায়? যাদের হাদিয়া উপঢৌকন এমন ছিল যে, পৃথিবীর সব প্রান্ত থেকে তা নেয়ার জন্য আরোহীরা জড়ো হতো।

সেখানে আছে এমন এক হাউস (মৃত্যু), যেখানে কোনো একদিন না নেমে উপায় নেই। যেভাবে নেমেছেন পূর্ববর্তীরা।

লেখক : প্রাবন্ধিক