‘হাজী সাইফুল অধ্যায়ের’ অবসান, এবার ইয়াবামুক্ত হবে দেশ?

শাহেদ মিজান :

ইয়াবার নাম আসলেই প্রথমে যে নামটি উঠে তিনি সাইফুল করিম ওরফে হাজী সাইফুল। সাইফুল করিম টেকনাফ সদর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্র্ডের শিলবনিয়াপাড়া গ্রামের ডা. হানিফের ছেলে। কথিত আছে, তার হাত দিয়েই বাংলাদেশে প্রবেশ করে মরণনেশা ইয়াবা। তার হাত ধরেই টেকনাফসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার অর্ধেকের বেশি শীর্ষ ইয়াবা কারবারী ইয়াবা ব্যবসায় নিজেদের জড়ায়। শুধু তাই নয়; মায়ানমারের ইয়াবা প্রস্তুতকারী ও ইয়াবা প্রস্তুত প্রক্রিয়ার সাথেও সরাসরি হাত ছিলো হাজী সাইফুলের। এভাবে তিনি হয়ে উঠেন দেশের এক নাম্বার ইয়াবা ডন! এতে তিনি হয়েছেন অঢেল টাকার মালিক। দেশে বিদেশে তার হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে বলে বেশ প্রচলিত রয়েছে। যাপন করেছেন বিলাসী জীবন। দীর্ঘ সময় ধরে দেশে ইয়াবা নিয়ে বেশ কড়াকড়ি বাড়লেও বরাবরই এই ইয়াবা মাফিয়া ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু কথায় আছে ‘সের পুরালে শেষ’! তাই বুঝি নিমিষেই শেষ হলো ইয়াবা জগতের সাইফুল অধ্যায়। অবিশ^াস্য হলেও দেশের নাম্বার ওয়ান ও মোস্ট ওয়ান্টেড সাইফুল করিমের নিহত হয়েছেন।

বৃহস্পতিবার (৩০ মে) দিবাগত রাত সাড়ে ১২ টার দিকে টেকনাফ স্থল বন্দরের সীমানা প্রাচীরের শেষ প্রান্তে নাফ নদীর পাড়ে পুলিশের সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ তিনি মারা গেছেন!

সাইফুল করিম নিহতের ঘটনাটি মুহূর্তের মধ্যে দেশজুড়ে ছড়িয়ে গেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসুবকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে মানুষ সাইফুলের মৃত্যু নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে। ফেসুবকের নানা জনের মন্তব্যে উঠে আসছে দেশের নাম্বার ওয়ান ইয়াবা ডন হাজী সাইফুল মারা গেলো। এবার কী তাহলে দেশ ইয়াবামুক্ত হবে? সেখানে অনেকে প্রশ্ন রাখছেন- টেকনাফে ইয়াবা বিরোধী অভিযানে এতো দিন যারা মারা গেছে তারা ছিলো ‘চুনোপুটি’। শীর্ষ ইয়াবা কারবারীদের কেউ মারা যায়নি। এই নিয়ে বিভিন্ন সময় সচেতন লোকজন নানাভাবে বিরূপ মন্তব্যও করেছিল। এর জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ‘তিরস্কার’ও করা হয়। তবে হাজী সাইফুল মারা যাওয়ার পর দেশের মানুষের এই অভিযোগ ঠুনকো হয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন।

জানা গেছে, বাংলাদেশে প্রথম ইয়াবা ঢুকে ১৯৯৭ সালে। আর প্রথম দফায় বাংলাদেশে ইয়াবার চালান এনেছিলেন সাইফুল করিম। বিভিন্ন সময় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক সাইফুল করিমের সহযোগিতা এই তথ্য দিয়েছেন। এসব জবানবন্দি ও নানা তথ্য ঘেঁটে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও তা শতভাগ নিশ্চিত হয়েছে।

সচেতন লোকজন বলছেন, ইয়াবা কারবারীরা দেশের কয়েক প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের একটি বিশাল অংশ ইয়াবার ছোবলে ধ্বংস হয়ে গেছে। এই অপূরণীয় ক্ষতির জন্য সাইফুল করিমই প্রথম দায়ী। বহু সময় পর হলেও তার ইয়াবা সাম্রজ্যের অবসান হলো। সাইফুল করিমই যখন বাঁচতে পারলো না, তাহলে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা সব ইয়াবা মাফিয়ারও একই পরিণতি হবে। তা যদি অব্যাহত তাহলে এবার কি দেশ ইয়াবা মুক্ত হবে?

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালের পর ইয়াবা বিরুদ্ধে কড়াকড়ি বাড়ায় সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। এর জন্য ইয়াবা ব্যবসায়ীদের তালিকা তৈরি করা হয়। প্রায় প্রতিটি তালিকায় নাম্বার ওয়ানে ছিলো সাইফুল করিমের নাম। সর্বশেষ ২০১৮ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ১ হাজার ১৫১ মাদক জন ব্যবসায়ীর তালিকায় প্রথম নামটি ছিল তার নাম। গেল ফেব্রুয়ারিতে কক্সবাজারে ১০২ মাদক ব্যবসায়ীকে আত্মসমর্পণ করাতে যে মাধ্যমটি ভূমিকা রেখেছিল, সেই মাধ্যমেই তিনি আত্মসমর্পণে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তিনি আত্মসমর্পণ করেননি। এবারের ঈদের পর ইয়াবা ব্যবসায়ীদের দ্বিতীয় দফায় আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের কথা ছিলো। এই দফায় আত্মসমর্পণ করার জন্য সম্প্রতি তিনি মায়ানমার থেকে দেশে এসেছিলেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ জানান, গত ৩ মে সাইফুলের দুই ভাই রাশেদুল করিম ও মাহবুবুল করিমকে আটক করে পুলিশ। তাঁরা দুজন সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে পারিবারিক ইয়াবা কারবার আড়াল করতেন। তাঁদের আরেক ভাই সাংবাদিক জেড করিম জিয়াও তাঁদের পারিবারিক ইয়াবা সিন্ডিকেটের সদস্য। সাইফুলের ভগ্নিপতি আবদুল্লাহ মনির টেকনাফ পৌরসভার প্যানেল মেয়র। তিনিও সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে সাইফুল পরিবারের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে আসছেন বলে পুলিশ দাবি করেছে।