কক্সবাজার মুক্ত দিবসের প্রথম পতাকা তৈরীকারী দর্জির খোঁজ কেউ রাখে না


শাহীন মাহমুদ রাসেল ::

একটি জাতীয় পতাকা মানে একটি জাতিরাষ্ট্রের অভ্যুদয়, একটি জাতির স্বীকৃতি। একটি জাতীয় পতাকা মানে একটি জাতির আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা, ভাষা, সংস্কৃতি তথা তার সাংস্কৃতিক পরিচয়। জাতীয় পতাকা সার্বভৌমত্বের প্রতীক। জাতীয় পতাকা আর জাতীয় সংগীত নিয়েই রাষ্ট্র স্থিতি লাভ করে এগিয়ে যায়। বাঙালি জাতি তার প্রাণপ্রিয় পতাকা অর্জনে অবর্ণনীয় দুঃখ-যন্ত্রণা ভোগ করেছে। বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছে। এই স্বপ্ন লালন করে কক্সবাজারে জাতীয় পতাকা তৈরীর সেই দর্জি বাঙালি জাতির বীরত্বগাথা ইতিহাসে স্থান করে নিতে পারেনি।

কিন্তু নানা কারণে লোকচক্ষুর আড়ালে রয়ে গেছেন আরো অনেকে। অনেকেরই মেলেনি স্বীকৃতি, রাষ্ট্রীয় সুবিধা। নিজ থেকেও অনেকে আর ওই পরিচয় দিতেও আগ্রহ প্রকাশ করেন না।

জীবনের বেশিরভাগ সময়ই এর কেটেছে দুর্বিষহভাবে। না রাষ্ট্র, না সমাজ, কেউ খোঁজ রাখেনি কক্সবাজার মুক্ত দিবসের পতাকা অর্জনের পেছনের এই আত্মত্যাগকারীর। ৭১’র রণাঙ্গনে সম্মুখ যুদ্ধে জয়ী হলেও জীবন যুদ্ধে আজও পরাজিত কক্সবাজার মুক্তদিবসের প্রথম পতাকা বানানো দর্জি ইব্রাহীম (৭০)। অভাব আর দারিদ্র্যতার সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে কাটে তার সারাজীবন। বিভিন্ন রুগে আক্রান্ত এই দর্জির দিন চলে সেলাই করে। বর্তমানে অসুস্থ অবস্থায় কক্সবাজার পৌরসভা মার্কেটের কোন এক গলিতে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তিনি। সে লোহাগড়া উপজেলার হাদুর পাড়া গ্রামের মৃত সুলতান আহম্মদের ছেলে।

দীর্ঘ আলাপচারিতায় জানালেন তার জীবন ও কক্সবাজারে প্রথম সেলাই করা জাতীয় পতাকার গল্প। ১৪-১৫ বছর বয়স থেকেই তিনি টেইলার্সে কাজ করেন। যার জন্য লোহাগড়া থেকে কক্সবাজার চলে আসেন। পৌরসভা মার্কেটের বড় বাজারে এক‌টি টেইলার্সে নিয়মিত কাপড় সেলাই করাই তার একমাত্র কর্ম। দেশ স্বাধীন হওয়ার ৯ মাস পূর্বে হঠাৎ একদিন মুক্তিযুদ্ধা মনছুরসহ ৪/৫ জনের একটি দল আসে পতাকা বানাতে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্যাতন নিপিড়নের ভয়ে কেউ সাহস করেনি পতাকা তৈরী করতে। ইব্রাহীম দর্জি বুকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করলেও ঝাপিয়ে পড়তে পারেনি মুক্তির সংগ্রামে, কারণ বাড়িতে অসহায় বাবা মায়ের একমাত্র উপার্জনকারী ছিল দর্জি ইব্রাহীম। তাই সে পতাকা তৈরীর সিদ্ধান্ত নিলেন এবং পতাকা তৈরী করে দেন। খবর পেয়ে তাদের ধরে নিয়ে এরই মধ্যে পাকিস্তানিরা হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। এরপর থেকে তার উপর শুরু হয় নরপশুদের অমানবিক নিপীড়ন-নির্যাতন। শুধু তার উপর নয়, ওই মার্কেটের কোন দর্জিই সেদিন রেহাই পাইনি নরপিশাচদের হাত থেকে। একজন কমান্ডারের নির্দেশে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করে প্রাণে বাঁচতে পালিয়ে যান ইব্রাহীমসহ অন্যান্য দর্জিরা।

দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ শেষে দেশ যখন স্বাধীন হয়, তখন জন্মভূমি লোহাগড়ায় ফেরেন ইব্রাহীম। বাড়ি ফিরে পরলোকে চলে যাওয়ায় বাবাকে দেখতে পাননি তিনি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন দর্জি ইব্রাহীম। বিয়ের পর হাতে ছিল না তেমন কোনও কাজ, আবার বেছে নিলেন দর্জির কাজ। দুঃখ, দুর্দশার সংসার জীবনে পাঁচ সন্তানের জনক হন তিনি।

ইব্রাহীম আরও জানান, আজো তার ক্ষত স্থানে মাঝেমধ্যে এখনো ব্যথা অনুভূত হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধা মনছুর প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে ২ হাজার ৫ শত টাকা আর্থিক সহায়তা এনে দেন। এর পর দীর্ঘ ৪৭ বছর অতিবাহিত হলেও দর্জি ইব্রাহিমের কেউ খোঁজ রাখেনি। এখন দর্জি কাজ করে যা ইনকাম হয়, অন্যান্য খরচ মিটিয়ে শেষ পর্যন্ত তার হাতে যে টাকা থাকে তা দিয়ে সংসার চলে না এই দর্জির। কলেজ পড়ুয়া ছেলেটির লেখাপড়া শেষ করাতে পারলে ছোটখাট একটি চাকরি জুটবে সেই প্রত্যাশায় দিন কাটে এই দর্জির।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি,অভাবও এই মানুষটির জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। বয়সের কারণে যদি মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করা না যায়, তা হলে একজন সহায়ক মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেও যেন অন্তত ইব্রাহীমকে স্বীকৃতি দেয় সরকার।