অন্ধ মায়ের স্থান হলো গোয়ালঘরে!

ডেস্ক রিপোর্ট :

সরবানুর বয়স এখন ৯০ বছর। ১০ বছর আগে তিনি একদিন মাটিতে পড়ে যান। ব্যথা পান পায়ে। ট্যাবলেট খেয়ে প্রাথমিক চিকিৎসায় ভালোই ছিলেন কিছুদিন। ছিল অর্থের অভাব, ছেলেরা তাই উন্নত চিকিৎসা করাতে পারেননি তার। অচল হয়ে যান তিনি ধীরে ধীরে। তারপর একদিন পুরো অন্ধ।

বিপদের শেষ ধাপটা শুরু হয় সরবানুর তখনই। নিজে একা একা চলতে পারেন না, বিছানাতেই সবকিছু সারতে হয় তাই তাকে। সামর্থ্যহীনতা আর অপারগতার মিশেলে ছেলেরা একদিন মাকে রেখে আসেন পাশের পরিত্যক্ত গোয়ালঘরে, একটি ভাঙা চৌকিতে।

জরাজীর্ণ ওই গোয়ালঘরেই সরবানুর আজ প্রায় তিন বছর। আধা পেট আর বিনা চিকিৎসায় তার প্রতিদিন।

ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার বাঘড়ি গ্রামের ঘটনা এটি। আকলিমা আক্তার সেলিমা তার প্রতিবেশী। তিনি বলেন, ‘মশার কামড়, গরম কিংবা শীতে এখানেই পড়ে থাকেন বৃদ্ধ সরবানু। ঘরটি বসবাসের অযোগ্য। মানুষটা অন্ধ, অচল। তার সন্তানরা সচ্ছল নন; কিন্তু মায়ের সেবা তো করতে পারেন। তা না করে দুর্গন্ধে বিরক্ত হয়ে ওই ঘরে রেখে এসেছেন তাকে।’

পাঁচ সন্তানের মা সরবানু। উপজেলার বাঘড়ি এলাকার মৃত তাহের মল্লিকের স্ত্রী তিনি। তিন ছেলে, দুই মেয়ে নিয়ে ছিল সাজানো সংসার। বড় ছেলে মারা যান কয়েক বছর আগে। মেয়েরা থাকেন শ্বশুরবাড়িতে। ছেলেদের অভাবের সংসারে তার বাস। গায়ে খেটে সংসার চালান তারা।

গত ৩০ এপ্রিল মঙ্গলবার সরবানুকে দেখতে যাওয়া হয় রাজাপুরের বাঘড়িতে। ছেলেদের বসতঘরের উত্তর পাশে একটি গোয়ালঘর, প্লাস্টিক বস্তার বেড়া, ঘরে ময়লা-আবর্জনা, দুর্গন্ধযুক্ত বিছানা। সেখানে প্রায় অর্ধ আবরণে শুয়ে আছেন তিনি। দুর্গন্ধে দাঁড়িয়ে থাকা কষ্টকর। বিছানার ওপর রাখা একটি পাত্রে পানি, দুটি মরিচ, খানিকটা লবণ, ময়লাযুক্ত একটি বাটি। হাতড়ে এসব নিতে হয় বলে বিছানাতেই এসব।

‘সকালে কী খেয়েছেন?’

জবাব দেন না সরবানু। এড়িয়ে যান ব্যাপারটা। বরং পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘আমি কী খেয়েছি?’

বোঝা যায় সকালটা তার অনাহারেই কেটেছে।

‘দুপুরে কী খাবেন?’

‘মুড়ি আর গুড়।’ এবার জবাব দেন সরবানু।

দুই পুত্রবধূসহ পরিবারের লোকজন ও প্রতিবেশীরা এরই মধ্যে ফাঁকে এসে দাঁড়িয়েছেন। তাদের মুখ এবং অবয়ব একসঙ্গে বলে, ‘আমাদের করার কী আছে? আমরা না পারি তার চিকিৎসা করাতে, না খাওয়াতে। তা ছাড়া দুর্গন্ধে তার কাছেই যাওয়া যায় না। আমরা নিজেরাই যে অনেক গরিব, অসহায়।’

রাজাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সোহাগ হাওলাদার বলেন, ‘এ বৃদ্ধার বিষয়ে আমি জানতে পেরে দেখতে গিয়েছিলাম তাকে। তার স্মরণশক্তি ভালো। বংশীয় পরিবারের সন্তান তিনি। কিন্তু অশিক্ষা বা অসচ্ছলতা যেটাই বলুন, তার সন্তানদের অবহেলা ও অবজ্ঞার জন্যই আজ তার এ দুরবস্থা। পিঁপড়ার কামড়ে জর্জরিত হয়ে সেখানে দিন কাটাচ্ছেন। যখন পায়ে ব্যথা পেয়েছিলেন, তখন যদি মায়ের প্রতি ভালোবাসার টানে সন্তানরা সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যেতেন, চিকিৎসা করাতেন, তাহলে এ দুর্ভোগ হতো না তার।’

ঝালকাঠির জেলা প্রশাসক মো. হামিদুল হক এরই মধ্যে জেনেছেন বিষয়টি। সরকারি সফরে অস্ট্রেলিয়ায় এখন তিনি। সেখান থেকেই নির্দেশনা দিয়েছেন- শিশুসদনে যেন থাকার ব্যবস্থা করা হয় সরবানুর।