অফিস থেকে ছুটি নিয়ে কক্সবাজার থেকে ইয়াবা নিয়ে যান তারা

সমকাল :

কৌশল বদলে সীমান্তের ওপার থেকে মাদক এনে ছড়িয়ে দিচ্ছে সারাদেশে। বাহিনীর পরিচয় ব্যবহার করে বাড়তি সুবিধা মেলায় জড়িয়ে পড়ছে পুলিশ, আনসার ব্যাটালিয়ন, ফায়ার সার্ভিসসহ খোদ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিপ্তরের (ডিএনসি) অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এ যেন শর্ষের মধ্যে ভূত!

সম্প্রতি রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মাদক কারবারে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে পুলিশ, আনসার, ফায়ার সার্ভিস ও ডিএনসির সদস্যরা গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলে পরিচয়পত্র (আইডি কার্ড) দেখানোর পর সাধারণত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের তল্লাশি করা হয় না। এ সুযোগই নিচ্ছেন বাহিনীগুলোর সদস্যরা।

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, মাদক নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলের দায়িত্ব যাদের, তারাই কারবারে জড়িয়ে পড়লে ভয়াবহতা আরও বাড়বে। তাদের প্রতি মানুষের বিশ্বাসের ঘাটতি দেখা দেবে।

পুলিশ সদরদপ্তরের ডিআইজি (অপারেশন্স) আনোয়ার হোসেন বলেন, পুলিশের মাঠ পর্যায়ের সদস্যদের বারবার অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত না হতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। এর পরও দু-একজন জড়িয়ে পড়ছে। অভিযোগ পেলে তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। পুলিশের কেউ মাদকের সঙ্গে যুক্ত থাকলে তাঁর বিরুদ্ধেও প্রচলিত আইনে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

দমকলকর্মীর ইয়াবা সিন্ডিকেট
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সদস্য আলম হোসেন (৩৫) সাময়িক বরখাস্ত হয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর স্টেশনে সংযুক্ত আছেন। সরকারি কর্মচারী হয়েও তিনি গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জের দৌলতপুরের ইসলামপুর উত্তরপাড়ায় গড়ে তুলেছেন ইয়াবা সিন্ডিকেট। মাসে অন্তত ১২ হাজার ইয়াবা গ্রামে নিয়ে ভাবি আলেয়া তাজের কাছে রেখে আসেন। এর পর ফোন করে আলম খদ্দেরকে তাঁর ভাবির কাছ থেকে এগুলো সংগ্রহ করতে বলেন। দীর্ঘদিন দেবর-ভাবি কারবার করলেও সম্প্রতি তথ্য পান ডিএনসির মানিকগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের কর্মকর্তারা। গত ২১ নভেম্বর আলমের বাড়িতে অভিযানে গিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়ে ডিএনসির আভিযানিক দল।

অভিযানের তথ্য জানতে পেরে চতুর আলম মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক রেহেনা আকতার ও পুলিশ সুপার মোহাম্মাদ গোলাম আজাদ খানকে ফোন করে নিজেকে নির্দোষ ও চক্রান্তের শিকার দাবি করেন। ফাঁসানোর জন্য বাড়িতে ডিএনসি অভিযান চালাচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি। এক পর্যায়ে জেলা প্রশাসকের পক্ষে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং পুলিশ সুপার অভিযোগের বিষয়ে ডিএনসির মানিকগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক হামীমুর রশীদকে ফোন করে খোঁজ নেন।

জানতে চাইলে হামীমুর রশীদ বলেন, বাড়িতে ১ হাজার ৭০০ ইয়াবা পেয়ে আলমের ভাবি আলেয়া তাজকে গ্রেপ্তার করা হয়। দেবর-ভাবির দীর্ঘদিনের ইয়াবা সিন্ডিকেট সম্পর্কে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ সুপারকে বিশদ জানানোর পর তারা আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেন। পরে আলম ও আলেয়ার বিরুদ্ধে দৌলতপুর থানায় মামলা করা হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিসের নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ের উপসহকারী পরিচালক ফখর উদ্দিন আহাম্মদ জানান, আলমের ইয়াবা কারবারে জড়িত থাকার বিষয়ে লিখিত কোনো অভিযোগ তিনি পাননি। তবে ডিএনসির এক কর্মকর্তা ফোন করে বিষয়টি জানিয়েছেন।

কক্সবাজার থেকে ইয়াবা ঢাকায় আনেন তারা
মাদক মামলায় রাজধানীর মালিবাগ থেকে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) এএসআই আজহার আলীকে গ্রেপ্তার করে ডিএনসি। মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে ৪ হাজার ৬০০ ইয়াবা জব্দ-সংক্রান্ত মামলায় গত ২৮ অক্টোবর তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। ডিএনসি সূত্র জানিয়েছে, ২৭ অক্টোবর ভোরে কক্সবাজার থেকে চানুচিং চাকমাসহ দু’জন ইয়াবার চালান নিয়ে মোহাম্মদপুরে আসে। খবর পেয়ে সকাল পৌনে ১০টার দিকে আসাদগেট থেকে চানুচিং চাকমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি নারী সহযোগীর কাছে চালানটি দিয়েছিলেন আজহারকে দিতে। ওই নারীর কাছ থেকে ইয়াবা নিয়ে আসতে মোহাম্মদপুর আওরঙ্গজেব সড়কের একটি ভবনের ছাদে যান আজহার। ইয়াবার তথ্য গোপন করে ছাদে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সদস্যদের কাছে ব্যাগ রেখে বের হন তিনি। আভিযানিক দল সেখানে গিয়ে ইয়াবাগুলো জব্দ করে। মোহাম্মদপুর থানায় মামলার পরদিন আজহারকে গ্রেপ্তার করা হয়।

গত ১২ আগস্ট হানিফ ফ্লাইওভারে একটি বাস থেকে আটক হন কনস্টেবল আল আমিন। ধরা পড়ার পর পুলিশ সদস্য পরিচয় দিয়ে পার পাওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু শরীর ও ব্যাগ তল্লাশি করে ছয় হাজার ইয়াবা পায় ডিএনসির ঢাকা মহানগর উত্তরের খিলগাঁও সার্কেল। আল আমিন কক্সবাজারে কর্মরত। সেখান থেকে সরাসরি বাসে ইয়াবার চালান ঢাকায় আনেন। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানান, চালানটি বরখাস্ত কনস্টেবল শান্ত হাসানের। তিনি কক্সবাজার থেকে মেহেদির কাছ থেকে এগুলো নিয়ে আবদুল্লাহপুরে শান্তকে দিতে যাচ্ছিলেন। পরে আল আমিনকে ব্যবহার করে আবদুল্লাহপুর থেকে শান্তকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরই মধ্যে তাদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা খিলগাঁও সার্কেলের এসআই শাহ আলম।

ডিএমপির তদন্তে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে থানাভিত্তিক মাদক কারবারিদের নামের তালিকায় পাঁচ পুলিশ সদস্যের নাম আসে। তারা শ্যামপুর ও কদমতলী থানায় কর্মরত ছিলেন।

কম যান না ডিএনসির কর্মকর্তা-কর্মচারী
বরিশাল শহরের পলাশপুর বস্তিতে গাঁজা বিক্রি করতে গিয়ে ২৫ সেপ্টেম্বর ধরা পড়েন ডিএনসির জেলা কার্যালয়ের এসআই ওবায়েদুল্লাহ ও সিপাহি সবুর। পরে স্থানীয়রা দেড় কেজি গাঁজাসহ তাদের পুলিশে দেন। কাউনিয়া থানার মামলায় দু’জনকেই কারাগারে যেতে হয়। গত বছরের ২৩ নভেম্বর জব্দ করা গাঁজা বিক্রির অভিযোগ ওঠে ডিএনসির কুষ্টিয়া জেলা কার্যালয়ের পরিদর্শক বেলাল হোসেন, উপপরিদর্শক শেখ আবুল কাশেম ও হাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের আদেশে জেলার বিভিন্ন ইউনিটের জব্দকৃত মাদক আলামত গত ২৩ আগস্ট ধ্বংস করা হচ্ছিল।

এ সময় উপস্থিত ডিএনসির জেলা কার্যালয়ের মনোনীত সহকারী প্রসিকিউটর মাহমুদুল হাসান ১ হাজার ২২টি ইয়াবা পকেটে রেখে দেন। কার্যক্রম শেষে প্যান্টের পকেট উঁচু দেখে ম্যাজিস্ট্রেটরা ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসার এক পর্যায়ে মাহমুদুল ইয়াবাগুলো বের করে দেন। পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়।

ডিএনসির পরিচালক (অপারেশন্স ও গোয়েন্দা) তানভীর মমতাজ জানান, তাদের কারও বিরুদ্ধে মাদকের সঙ্গে সম্পৃক্ততা পেলে বিভাগীয় ছাড়াও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে।

অফিস থেকে ছুটি নিয়ে ইয়াবা পাচার
মিলন কুমার বিশ্বাস বান্দরবান-৪ আনসার ব্যাটালিয়নে কর্মরত। অসুস্থ ভাইকে দেখার কথা বলে দু’দিনের নাইট পাস (ছুটি) নেন তিনি। কিন্তু মিলন কক্সবাজার থেকে ইয়াবার চালান নিয়ে ঢাকা হয়ে গত ১৮ নভেম্বর ফরিদপুরে যান। খবর পেয়ে ওই দিন সকালে ডিএনসির ফরিদপুর জেলা কার্যালয়ের কর্মকর্তারা দুই হাজার ইয়াবাসহ তাঁকে গ্রেপ্তার করেন। মিলনের বাড়ি ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গার সরারকান্দী গ্রামে।

আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর গণসংযোগ কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম জানান, এ ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার প্রমাণ পেলে তাঁর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।