আট হাজার টাকা বেতনের সিঙ্গার শো-রুম কর্মচারী রহিম উদ্দিন এখন শত কোটি টাকার মালিক!

নিউজ কক্সবাজার :

পরিবারের অবস্থা তেমন ভাল ছিল না। নুন আনতে পান্তা এক সময়কার টেকনাফে আট বছর আট হাজার টাকা বেতনে সিঙ্গার শো রুমে চাকরী করে তিনি এখন শত কোটি টাকার মালিক। একসময় নুন আনতে যাদের পান্তা ফুরাত সে এখন টাকা দিয়ে সব দিকে ম্যানেজ করেন।

শত কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া এই রহিম উদ্দিন সারাজীবন সিঙ্গারের ইলেকট্রনিক সামগ্রী বিনামুল্যে এনে দাম ধরে বিক্রি করলেও এতো টাকার মালিক হওয়া সম্ভব নয়, এমন দাবী স্থানীয়দের। সিঙ্গার শো রুমে চাকরি করে গত ৬/৭ বছরে শত কোটি টাকার মালিক হওয়া নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের মাঝে কৌতুহলের শেষ নেই।

তার অন্যতম ইয়াবা ব্যবসার সহযোগী টেকনাফ সদরের বাসিন্দা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত এক ইয়াবা ডন। দিনদিন বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে রহিম উদ্দিনের সিঙ্গার শো রুমে চাকরির অড়ালে ইয়াবা সাম্রাজ্যের লোমহর্ষক কাহিনী।

তাঁর নাম মো. রহিম উদ্দিন। কিন্তু এই নামে তিনি তেমন পরিচিত নন। কক্সবাজার সদরের ঝিলংজা ইউনিয়নের খরুলিয়া মুন্সিরবিল এলাকার মৃত আবদু শুক্কুরের ছেলে রহিম উদ্দিন ৩১ বছর বয়সী এই যুবক পরিচিত ‘ইয়াবা’ রহিম নামে। খরুলিয়া মুন্সিরবিল গ্রামে কিছু মানুষকে টাকা দিয়ে তাদের কাছে জনদরদি সেজেছেন।এলাকায় নিজের প্রতিপত্তি ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে এবং নিজেকে ‘সেভ’ রাখতে রহিমের এই কুটকৌশল। সিঙ্গার প্লাস শো রুমকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে টেকনাফ থাকতেই এসবের আড়ালে তাঁর আসল পেশা ছিল মাদক ব্যবসা।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে ইদানিং  পরিচিতি পেয়েছে রহিম ও তার ভাগিনা ইরহান। প্রতিমাসে তিনি লাখ লাখ টাকা আয় করেন মাদক ব্যবসা থেকে। তবে পুলিশ সহজে তাঁর নাগাল পায় না।

এলাকাবাসী জানান, রহিম উদ্দিন ছোট বেলায় অর্থাভাবে বাতুশ শরফ এতিমখানায় ৪/৫ ক্লাস পড়ার পর খরুলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। অভাবের কারণে ২/১ বছর পর আর পড়া হয়নি তার। মাত্র ৮ হাজার টাকা বেতনে কক্সবাজার বাজারঘাটাস্থ সিঙ্গার শো-রুমে পেয়েছিলেন চাকরি। এক পর্যায়ে পদোন্নতি পেয়ে হয়েছিলেন সিঙ্গার টেকনাফ শাখায় মাঝারি মানের কর্মকর্তা।

চাকরি সময় টেকনাফের বিভিন্ন ব্যক্তির সাথে পরিচয় ঘটে। এর মধ্যে বিভিন্ন ইয়াবা কারবারীদের সাথেও তার ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। লুফে নেন ইয়াবা ব্যবসার মন্ত্র। সব চেয়ে বেশি সখ্যতা গড়ে উঠে টেকনাফ মাফিয়া ডন ইয়াবা কারবারী পরিবারের সাথে। ঘনিষ্টতা ও ব্যবসয়ীক পার্টনার হয়ে উঠেন। এভাবে কালো জগতে পা বাড়ান রহিম। টেকনাফ সিঙ্গার শো রুমে চাকরি করলেও
তিনি নিয়মিত মোটরসাইকেল যোগে কক্সবাজার খরুলিয়া থেকে টেকনাফ আসা যাওয়া করতেন। চাকরিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সেখানেই পেয়েছিলেন ‘আলাদিনের চেরাগ’র সন্ধান! ওই আলাদিনের চেরাগটি ছিলো ইয়াবা! সিঙ্গারের কর্মকর্তার পদকে ব্যবহার করে কৌশলে পাচার করেছেন অগণিত ইয়াবার চালান। এভাবে তিনি ৮ হাজার টাকা বেতনের চাকরি থেকে হয়ে উঠেন অঢেল সম্পদের মালিক।

জানা গেছে, ২০১৪ সালে টেকনাফের ওই ইয়াবা ডন ও রহিম উদ্দিন এর একটি ইয়াবার চালান আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বহনকারীকে ইয়াবাসহ টেকনাফ থানায় সোপর্দ করা হয়। এ ঘটনায় রহিম উদ্দিনকেও ওই মামলা আসামি করে হলে সেই সময় টেকনাফ থেকে চাকরি ছেড়ে দিয়ে কক্সবাজার চলে আসে। বিভিন্ন কায়দায় ওই মামলার চার্জসীট থেকে বাদ যান রহিম উদ্দিন। সেই সময় আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তার বাড়িতে একাধিকবার অভিযান চালান। কক্সবাজারে এসে বাস টার্মিনাল এলাকায় সিঙ্গার প্লাস নামের কোটি টাকা বিনিয়োগে একটি শো-রুম খুলে বসেন তিনি। তবে টেকনাফ সিঙ্গার শোরুমে রহিম উদ্দিনের কর্মস্থলে তার ভাগিনা ইরহানকে স্থলাভিষিক্ত করা হয়। সেখানে রহিম উদ্দিনের অধীনে আরো একটি সিঙ্গার শো-রুম খোলা হয় বলে জানা যায়।

স্থানীয়রা দাবি করেন, রহিমের আপন ভাগিনা খরুরিয়া সিকদারপাড়া গ্রামের মোস্তফার ছেলে ইরহান টেকনাফ শো রুমে যোগদান করার আগে ও পরে তারা মামা ভাগিনা দেশব্যাপী শুরু করে ইয়াবা জোরদার ও পাচার। ইরহান বর্তমানে টেকনাফ অবস্থানরত। সম্প্রতি ঝিলংজা ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃক পুলিশের কাছে জমা দেয়া ঝিলংজার ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকায় ইরহানের নাম রয়েছে শীর্ষে।

অভিযোগ রয়েছে, রহিমের ভাগিনা ইরফান বিভিন্ন সময় টেকনাফ থেকে নষ্ট ফ্রিজ টিভি মেরামত ও সার্ভিসিং এর নামে কৌশলে ইয়াবা ভর্তি করে কক্সবাজার ও ঢাকায় পাঠিয়ে আসছিল।

কথিত রয়েছে, ভাগিনা ইরহানও এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। এমনকি মামা-ভাগিনা গোপনে প্রতি বছর ৩ থেকে ৪ বার সফর করেছেন ইউরোপেসহ বিভিন্ন দেশ। রহিম উদ্দিন বিভিন্ন জনপ্রতিনিধি, বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে সন্তুষ্টি রেখে এই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ।

তার এই অস্বাভাবিক অর্থ-সম্পত্তি নিয়ে কথায় তোলায় এলাকার জনপ্রতিনিধি ও গণমান্য ব্যক্তিদের মোটা টাকা দিয়ে নীরব রেখেছেন। এভাবে রহিম রয়ে গেছেন ইয়াবা সংশ্লিষ্টতার আলোচনার বাইরে!।

কথিত রয়েছে, সম্প্রতি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা পুরো ঝিলংজার মাদক ব্যবসায়ীদের একটি তালিকা করে। এতে শীর্ষে নাম উঠে সিঙ্গার রহিমের। তবে রহিম রহস্যজনক উপায়ে ওই তালিকা থেকে নাম বাদ দিতে ‘সক্ষম’ হয়েছেন বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।

রহিম কলাতলি রোডে, হোটেল মোটেল জোনে কয়েকটি স্পষ্টে তার মাদক ব্যবসা চালায়। ওশান প্যারাডাইসের পেছনে একটি হোটেলে মাসিক রুম রেখেছে তার। সেখানে বসে ইয়াবা ব্যবসার চক আঁকা হয় বলে সুত্রে প্রকাশ।

ধারাবাহিকতায় টেকনাফ সিঙ্গার শোরুম থেকে দুটো নষ্ট ফ্রিজ সার্ভিসিং এর নামে কক্সবাজার বাস টার্মিনাল সিঙ্গার শোরুমে পাঠানো হয়। আর এই ফ্রিজের ভিতরে ছিল ইয়াবা। গত ২০১৪ সালের ১৬ নভেম্বর রাতে কক্সবাজারস্থ র‌্যাব-৭ এর একটি দল বাসটার্মিনালস্থ সিঙ্গার শো-রুম থেকে ইয়াবাসহ সিঙ্গারের বিক্রয় প্রতিনিধি আয়াছুর রহমানকে আটক করে। পরে উদ্ধারকৃত ইয়াবাসহ সংশ্লিষ্ট ধারায় মামলা দিয়ে তাকে থানায় সোপর্দ করা হয়। কিন্তু বিভিন্ন ভাবে তদবিরে রহিম উদ্দিন সেই যাত্রায়ও বেচে যান। কক্সবাজার সদর উপজেলার ভারুয়াখালী এলাকার আয়াছুর রহমান দীর্ঘদিন যাবত শহরের বাসটার্মিনালস্থ সিঙ্গার শো-রুমে বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।

জিজ্ঞাসবাদে আয়াছ জানায়, ইয়াবার চালান রহিম পাঠায়। আয়াছ দীর্ঘদিন কারাভোগ করলেও পরে মোটা অংকের বিনিমেয় রহিম সেখান থেকেও পার পেয়ে গেছে।

অভিযোগ ওঠেছে শো-রুম ম্যানেজার রহিম উদ্দিনের সহযোগিতায় ব্যবসার আড়ালে টেকনাফ থেকে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা এনে প্রায় সময় শহরের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করতেন আয়াছুর রহমান।

এছাড়াও চলতি বছর গত ৫ এপ্রিল বিকাল ৫টার দিকে বাস টার্মিনাল সংলগ্ন সিঙ্গার শো-রুম থেকে ইয়াবা নিয়ে বের হওয়ার পরপরই সিঙ্গার শো রুমের সামনে থেকে ১৬০০ ইয়াবাসহ মোহাম্মদ ছলিম (২০) নামে এক পাচারকারীকে আটক করেছে কক্সবাজার জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর টিম। আটক পাচারকারী টেকনাফের হ্নীলা ৬নং ওয়ার্ডের লেচুয়াপ্রাং এলাকার মোহাম্মদ আলমের ছেলে।

এ ঘটনায় উপ-পরিদর্শক শেখ আবুল কাশেম বাদী হয়ে কক্সবাজার মডেল থানায় মামলা করেন। এখানেও কৌশলে রক্ষা পান ডন রহিম উদ্দিন। একের পর এক তার ইয়াবা চালান আটক হলেও বরাবরেই রহিম উদ্দিন অধরাই রয়ে যায়।
খরুলিয়ার কয়েকজন বাসিন্দা জানালেন, কখনো কখনো ‘জনদরদি’ হয়ে যান এলাকায়। কেউ মাদকের বিরুদ্ধে কথা বললেই তাকে টাকা দিয়ে ম্যানেজের অভিজ্ঞতাও তার বেশ পুরনো।

অনুসন্ধানেে জানা গেছে, খরুলিয়া নিজ গ্রামে কিনেছেন অনেক জমি। মেরিন ড্রাইভ সড়কে তিনি ও তার ভাগীনা ইরহানসহ আরেক গডফাদার শাহজাহান মিয়া মিলে সাড়ে ৩ একর মূল্যবান জমি কিনেছে। ব্যক্তিগত গাড়ি আছে, ৭টি টিআরএক্স, ভক্সি গাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এনজিওর কাছে ভাড়া দিয়েছে। আর সবই করেছেন মাদক ব্যবসার টাকায়। খরুলিয়া নিজ গ্রামে অনেককে মোটা টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে এভাবেই মাদক ব্যবসার নিরাপদ বলয় গড়েছেন রহিম উদ্দিন।

স্থানীয় সূত্রে অনুসন্ধান করে জানা গেছে, সিঙ্গারে চাকরি করলেও বহুদিন মা ও বোনকে নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করেছিলেন রহিম। কিন্তু ২০০৭ সালে টেকনাফ শো রুমের নিযুক্ত হওয়ার পর হঠাৎ বদলে যায় জীবনচিত্র। তিনি দিনে দিনে হয়ে উঠছিলেন ‘টাকাওয়ালা’। বদলে যেতে থাকে তার ও তার পরিবারের লোকজনের হাল-হকিকত। ক্রমান্বয়ে মালিক হন অঢেল টাকার। গড়েছেন অঢেল সম্পদ। এই টাকা দিয়ে জেলার বিভিন্ন জায়গায় কিনেছেন বহু জমি। কক্সবাজার কলাতলী রোড়ে রয়েছে দুটো স্টুডিও এ্যাপার্টমেন্ট। এই অ্যাপার্মেন্ট স্টুডিও দুটির দাম অন্তত ৮৯ লাখ টাকা, রয়েছে একাধিক গাড়ি। বিভিন্ন ব্যাংকে নামে-বেনামে রয়েছে বহু ডিপোজিট ও ব্যালেন্স।

একাধিক সূত্রের দাবি, রহিমের মেয়ের স্কুলের জন্য ড্রাইভারসহ একটি প্রাইভেট কার, রয়েছে তিনটি ডাম্পার। অন্যদিকে বাস টার্মিনাল এলাকায় ৪ গন্ডা জমিতে রয়েছে ফ্যামিলি কোয়াটার। প্রাইম ব্যাংক ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকে রয়েছে ২ থেকে আড়াই কোটি টাকা ফিক্স ডিপোজিট। কক্সবাজার শহরের আশেপাশের বিভিন্ন প্রামে নামে-বেনামে ক্রয় করেছেন ৩ একর জমি। নিজ এলাকায় রয়েছে আলিশান বাড়ি।

স্থানীয়রা জানান, রহিম এলাকায় সিঙ্গার রহিম নামে পরিচিত। অর্থে-কষ্টের কারণে এক সময় তাদের ঘরে ঠিকমতো বাজার-সদাই হতো না। তার বর্তমান চাল-চলনে মনে হয় রহিম এখন অন্তত শতকোটি টাকার মালিক।

ইয়াবা কারবারে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে রহিম উদ্দিন বলেন, আমি ২০০০ সাল থেকে সিঙ্গার শো-রুমে আছি। এরপর টেকনাফে দায়িত্ব পালন করি। বর্তমানে কক্সবাজারে বেঞ্জ ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করছি। এতে অনেক টাকার বেতন হয় আমার। এছাড়া আমার পৈত্রিক সম্পত্তি রয়েছে অনেক। এতো কিছু থাকার পর কেন আমার অবৈধ ব্যবসা করতে হবে? আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। সম্পত্তির বিষয়ে ষড়যন্ত্র হিসেবে আমার বিরুদ্ধে অনেকেই লেগে আছে। আমি কোন সময় অবৈধ ব্যবসায়ে জড়িত ছিলাম না।

কক্সবাজার সদর মডেল থানার ওসি ফরিদ উদ্দীন খন্দকার পিপিএম বলেন, মাদকের মামলা বা অভিযোগ নেই; এমন অনেকেই মাদকের সাথে জড়িত রয়েছে। আমরা তাদের নজরদারীতে রেখেছি। খরুলিয়া এলাকার অনেকেই বিভিন্ন ব্যবসার আড়ালে মাদকের সাথে জড়িত বলে তথ্য রয়েছে। নিয়মিত অভিযানে আমরা অনেকজনকে আটকের পর আদালতে চালান দিয়েছি। ধারাবাহিকভাবে সবাইকে আটক করা হবে। সূত্র- নিউজ কক্সবাজার