এক যুগ পরে মাঠে নেমে ঝর্ণার ‘ছক্কা’

উদিসা ইসলাম ◑২০২০ সালের বলিউডের অশ্বিনী তিউয়ারী পরিচালিত পাঙ্গা সিনেমার স্ক্রিপ্ট যেন নেমে এসেছে পল্টনে। সিনেমায় দুর্দান্ত লড়াকু খেলোয়ার সন্তানসম্ভাবা হওয়ার পর খেলা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। নানা চড়াই-উতরাইয়ের পর ছেলে বড় হলে সে চায় মা আগের মতো মাঠে নামুক। কুস্তি লড়ে মা আবারও প্রমাণ দেয়,খেলোয়াড়ের জীবন খেলোয়াড়েরই থাকে।

রাজধানীর পল্টনে শুক্রবার তেমনই এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হন ঝর্ণা আক্তার চিনি। ১২ বছর আগে খেলোয়াড় জীবনের ইস্তফা দিয়ে ১১ বছরের ছেলের সঙ্গে ক্রিকেট খেলতে নেমে গণমাধ্যমের ক্যামেরায় ধরা পড়েন। ঝর্ণা বলেন, ছেলে কয়েক বছর হয় সবসময় বলে মা তুমি এতো ভাল খেলো, আমার সঙ্গে খেললেওতো পারো। শুক্রবার থেকে শনিবার পুরো দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের চোখেও ঝর্ণা স্টার। আর তার এই খেলার ছবি আরো বেশি করে সবার নজর কেড়েছে কেননা ঝর্ণা বোরখা পড়েন। পর্দা কোনও কিছুর জন্য বাধা হতে পারে না উল্লেখ করে ঝর্ণা বলেন, আমি কাউকে দেখানোর বা মিডিয়ার জন্য কিছু করিনি। আমার ছেলেটা খেলে তাকে সঙ্গ দিয়েছি প্রতিদিনের মতোই। আমার অ্যাথলেট জীবন আমি পিছে ফেলে এসেছি, সামনের নিজের জন্য কিছু চাই না। কেবল চাই আমার ছেলেটাকে বিকেএসপি পর্যন্ত পৌঁছে যেন দিতে পারি।

শনিবার সকাল থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝর্ণা আক্তার ও তার ছেলের খেলার ছবি ছড়িয়ে পড়লে প্রতিবেদকের সঙ্গে যোগাযোগ হয় তার সাথে। মতিঝিলের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলার সময় বোরখার আড়ালে এক বুদ্ধিদীপ্ত মা আর খেলোয়াড় ঝর্ণার দেখা মেলে। ঝর্ণা বলেন, আমি খেলোয়াড় পরিবারে বড় হয়েছি। ছোট ভাই জাতীয় ফুটবল দলে স্ট্রাইকার রোকনুজ্জামান কাঞ্চন, ওকে কেউ আমার ছোট ভাই বলে না, বড় ভাইই ভাবে। আমি এতোই ছেলেমানুষি আনন্দ নিয়ে কাটাই। আমার জীবনে কোনও হতাশা নেই। মরার আগেও যদি আমাকে কেউ খেলতে বলে নেমে পড়ব  হয়তো মাঠে।

শুক্রবার কী ঘটেছিল বলতে গিয়ে উচ্ছাসে ফেটে পড়তে থাকেন এই মা। তিনি বলেন, আমি থাকি শ্যাওড়াপাড়া। আমার ছেলেটাকে আরামবাগে একটা মাদ্রাসায় দিয়েছি।ওকে আমি রোজ মাঠে নিয়ে যাই নজরুল অ্যাকাডেমির হয়ে খেলা শেখে। শুক্রবার একটু দেরি হচ্ছিল। ছেলে বলল, মা তুমিতো ভাল বল করো, আজ  তুমি আমার সঙ্গে খেলো। আমার যে কী হলো এক সাইডে গিয়ে ছেলে ক্রিচে ব্যাট নিয়ে দাঁড়ালো আমি বল করলাম। সলজ্জ ঝর্ণা বলেন, ছেলেকে আউটও করে দিলাম। তখন ছেলে আমাকে তার ব্যাট দিয় বলল, এবার তুমি ব্যাট করো। সময়টার কথা মনে করতে গিয়ে চোখ যেন চকচক করে উঠলো ঝর্নার। আমি  প্রতিটা বল ব্যাটে টাচ করতে পারছিলাম। আমরা দুজনেই ভাবিনি কে দেখছে বা কী ঘটছে। এতো আনন্দ করছিলাম মা আর ছেলে। অনেকদিন এত আনন্দ পাইনি। এক সময় দেখি নেটের চারপাশে লোকজন, ক্যামেরাও দেখতে পাই। বুঝতে পারি,অনেক সাংবাদিকও চলে এসেছেন।

প্রতিবেদকের সঙ্গে ঝর্ণা আক্তার প্রতিবেদকের সঙ্গে ঝর্ণা আক্তার

চট করে জিজ্ঞেস করি,আপনি ছবি তুলতে নিষেধ করেননি। ঝর্ণা চটজলদি জবাব দিলেন, শুরুতে বলেছি প্লিজ ছবি তুলবেন না, আমি  ছবি তুলি না। তারপর মনে হয়েছে আমিতো পর্দা করা, ছবি তুললে কী আর এমন হবে। তখন সাংবাদিকরা পরস্পর আলাপ করছিল বোরখা পরা মা আর তার ছেলের ক্রিকেট খেলার ছবি বিশ্বকে কাঁপিয়ে তুলবে। আমারও তখন মনে হয়েছে,আমার মুখ দেখা যায় না,আমি সবসময় হাতে মোজা পরি কিন্তু এই ছবি অনেককে উদ্বুদ্ধ করলে করুক, তখন আর নিষেধ করিনি।

কী খেলতেন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন আমিতো অ্যাথলেট ছিলাম। ২০০মিটার দৌড়, লংজাম্প, চাকতি নিক্ষেপসহ আরও অনেক কিছু জেলা পর্যায়ে খেলেছি। তার পরতো যা হয়। ঘর সংসার মিলিয়ে হয়ে ওঠেনি। বলতে গিয়ে চঞ্চল চোখদুটো একটু শান্ত হলো যেন। ঝর্ণা বললেন, সবাই জানতে চাইছে পরিবারের প্রতিক্রিয়া। বিশ্বাস করেন, বাবা বেঁচে থাকলে আজ  অসম্ভব খুশি হতো। তারচেয়ে আনন্দ আর কেউ পেত না। আর মা তো বিছানাগত। এখন আমার স্বপ্ন ছেলেটাকে ঘিরেই। ওকে যদি বিকেএসপিতে পাঠাতে পারি। এই মাদ্রাসা জীবন থেকে বেরিয়ে সে একটা অন্যরকম জীবনে যেতে পারতো। আর আমি আমার সকল কস্ট ভুলে যেতাম।

যখন কথা বলছি তার মাঝেই একের পর এক কল আসছে। কেউ লাইভ করতে চান, কেউ ফোনে সাক্ষাৎকার নিতে চান। উনি হাসছেন খালি। আর বলছেন, আমি এসব কিছু ভাবতে পারছি না। আমার কথা লোকজন শুনছে। আমার ছেলেটার জন্য দোয়া করবেন। আপাতত শেষ কোন কথা বলতে চান কিনা প্রশ্নে ঝর্ণা বলেন, এতরকমের স্ট্রাগলের পরেও আমার কোনও ক্লান্তি নেই। তবে আপাতত মাঠেই ছেলেটাকে নিয়ে যেতে আসতে চাই। ভয় হয়,আমাদের দিকে ফোকাস করায় অন্য খেলোয়াড় বা যারা শিখছে তারা আড়ালে চলে না যায়। খেলোয়ারের জীবনে হতাশা আশা খুব কষ্টের।