রোহিঙ্গাদের জরুরিভিত্তিতে ত্রাণ প্রয়োজন, এর জন্য কি চেষ্টা চালাবে বিশ্ব?

কক্সবাজার জার্নাল :

জাতিসংঘের ভাষায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জাতিগত নিধন অভিযান থেকে প্রাণ বাঁচাতে ১৮ মাস আগে নিজ ভূমি রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের অবস্থা ক্রমেই করুণ হয়ে উঠছে। কক্সবাজার জেলার কুতুপালংয়ে একটি উদ্বাস্তু শিবিরেই বাস করছে ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা। এরা জীবিকার জন্য বিশ্বখাদ্য সংস্থা ও বাংলাদেশ সরকারের সহায়তার উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল।কিন্তু আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো প্রতিশ্রুতির চেয়ে অনেক কম সাহায্য দেয়ায় বাংলাদেশের কর্মকর্তারা এখন হতাশ। রোহিঙ্গারা এখনো দেশে ফিরে যাওয়া ও যারা তাদের এই দুর্ভোগের জন্য দায়ী তাদেরকে বিচারের কাঠগড়ায় দেখতে পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে।দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাদের ফিরে যাওয়া ও দায়ি মিয়ানমার বাহিনীর সদস্যদের বিচারের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা কম। বৌদ্ধ সংখ্যাগুরু মিয়ানমারে মুসলিম রোহিঙ্গারা এমন এক পরিবেশে বাস করছে যাকে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ ‘বর্ণবাদের মতো’ বলে উল্লেখ করেছে।

২৫ জানুয়ারি জাতিসংঘের মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ ‍দূতের রিপোর্টে বলা হয়, মিয়ানমার সেনাবাহিনী এখনো রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে সহিংসতা, ভীতি প্রদর্শন ও হয়রাণি অব্যাহত রেখেছে। সেনাবাহিনীর দমননীতিকে মৌন সমর্থন দেয়ার জন্য তিনি নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী অং সান সু চি’র বেসামরিক সরকারকেও দায়ি করেন।বিশেষ দূত অপরাধিদের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার করার আহ্বান জানান। তবে তিনি শেষ করেন এই কথা বলে যে, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুরা নিকট ভবিষ্যতে মিয়ানমারে ফিরে যেতে পারছে না – এটা স্পষ্ট।রাখাইন রাজ্যে সহিংসতামিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নতুন করে সহিংসতা দেখা দেয়ায় রোহিঙ্গা পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের সীমান্ত লাগোয়া এই রাজ্যটিতেই মূলত বেশিরভাগ রোহিঙ্গার বাস। সম্প্রতি আরাকান আর্মি (এএ) সীমান্ত রক্ষাবাহিনীর চৌকিতে হামলা করলে সেখানকার নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি হয়।এএ’র হামলায় কয়েকজন পুলিশ অফিসার নিহত হলে সেনাবাহিনী ও পুলিশ রাজ্যটিতে প্রতিশোধমূলক পাল্টা অভিযান শুরু করে। যেকোন সন্দেহভাজন ও কাউকে এএ’র প্রতি সহানুভুতিশীল মনে হলেই তার উপর নিপীড়ন চালানো হচ্ছে। এই সহিংসতায় রাখাইন রাজ্যে হাজার হাজার মানুষকে এরই মধ্যে বাস্তচ্যুত করেছে। অনেকে পালিয়ে সীমান্তের ওপারে গিয়ে আশ্রয় নিতে চাইছে। রোহিঙ্গারা সাম্প্রতিক হামলার অংশ না হলেও মিয়ানমার সেনাবাহিনী বলছে যে এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতি রোহিঙ্গাদের ফেরত আসার উপযুক্ত নয়।এ অবস্থায় রোহিঙ্গা সমস্যা সামল দিতে বাংলাদেশ সরকার দুটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনএকটি পরিকল্পনায় রোহিঙ্গাদের বঙ্গোপসাগরের একটি দ্বীপে সরিয়ে নেয়ার কথা রয়েছে। ভাষানচর নামক ওই দ্বীপে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গার থাকার উপযোগী বাসস্থান ও অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ করছে বাংলাদেশ সরকার।এই স্থানান্তর বর্তমান উদ্বাস্তু শিবির ও আশপাশের শহর ও গ্রামগুলোর উপর চাপ কমাবে। বাংলাদেশ এই সমাধানের পক্ষে থাকলেও জাতিসংঘের বিশেষ দূত উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন যে এতে উদ্বাস্তেরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। তাছাড়া এই সমাধান গ্রহণ করা হলে তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বিষয়টি ভুলে যেতে সাহায্য করবে।রাখাইনে ‘নিরাপদ জোন’দ্বিতীয় প্রস্তাবটি হলো আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের জন্য একটি ‘নিরাপদ জোন’ গড়ে তোলা।গত সপ্তাহে ভারতীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপকালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিষয়টি তুলে ধরেন। তিনি এই পরিকল্পনা মেনে নিতে মিয়ানমার সরকারকে রাজি করানোর জন্য ভারত, চীন ও আশিয়ান সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানান।রোহিঙ্গাদের তাদের মূল আবাসভূমিতে পরিপূর্ণভাবে ফিরিয়ে নিতে এটা দ্বিতীয় সবচেয়ে ভালো আইডিয়া। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের উদ্বাস্তু শিবিরে রেখে দেয়ার চেয়েও এটা ভালো। কিন্তু ব্যাপক আন্তর্জাতিক চাপ ছাড়া মিয়ানমার সরকার এই পরিকল্পনা মেনে নেবে বলে মনে হয় না। কারণ এর মাধ্যমে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বসবাসের অধিকার স্বীকার করে নেয়া হবে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী এতদিন যে কথা বলে আসছে এই পরিকল্পনা তার বিরোধী। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশী অভিবাসী বলে মিয়ানমার সেনাবাহিনী মনে করে।‘নিরাপদ জোনের’ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা এবং ফিরে গিয়ে তাদের জীবনযাত্রা ‍শুরু করার জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী লাভের ব্যাপারে তৃতীয় পক্ষের (রাষ্ট্র বা আন্তর্জাতিক সংস্থা) কাছ থেকে জোরালো প্রতিশ্রুতি পেতে হবে।রোহিঙ্গাদের দুর্দশাফলে রোহিঙ্গাদের দুর্দশা অব্যাহত রয়েছে। কোন তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ছাড়াই মিয়ানমার সরকার তার গণহত্যামূলক নীতি অব্যাহত রেখেছে।বাংলাদেশ ও কিছু জাতিসংঘ সংস্থা ছাড়া বেশিরভাগ রাষ্ট্র মেনে নিয়েছে যে রোহিঙ্গাদের ভাগ্য তাদের কেন সমস্যা নয়। এখনকার মতো, নিরাপদ জোনের প্রস্তাবটি রোহিঙ্গাদের কিছুটা স্বস্তি দিতে সবচেয়ে ভালো বিকল্প হতে পারে, যদিও পরিকল্পনাটি পুরোপুরি যুতসই নয়। কিন্তু এটুকু বাস্তবায়নের জন্যও কি বিশ্ব রাজি হবে?