অনলাইনে শিক্ষক বদলিতে ডিজিটাল দুর্নীতি

ডেস্ক রিপোর্ট •

ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গি উপজেলার সনগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের শূন্যপদে দুইজন অনলাইনে বদলির আবেদন করেন।

তাদের একজন মহিষমারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ফিরোজা বেগম এবং অপরজন কলমদা পশ্চিমপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একরামুল চৌধুরী। নীতিমালা অনুযায়ী চাকরিতে সিনিয়রিটি, বাড়ি থেকে দূরত্ব এবং নারী হিসাবে ফিরোজা বেগমের পদটি পাওয়ার কথা। কিন্তু বদলির আদেশ পেয়েছেন একরামুল চৌধুরী।

আবার পটুয়াখালীর একটি উপজেলার শিক্ষা কর্মকর্তা এক শিক্ষককে নির্দিষ্ট একটি স্কুলে বদলির সুপারিশ করেছেন। কিন্তু আরেক স্কুলে তার বদলির আদেশ জারি হয়েছে। প্রথমবারের মতো চালু হওয়া ডিজিটাল পদ্ধতির এই বদলিতে এমন নানান ঘটনা ঘটেছে।

শিক্ষকরা বলছেন, বদলির জন্য যে সফটওয়্যার করা হয়েছে, সেটিতে আসলে ভূত ঢুকেছে। কারণ, এ বদলি পদ্ধতিও দুর্নীতি আর শিক্ষকের হয়রানি কমাতে পারেনি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নীতিমালা অনুযায়ী যার অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা তিনি বদলির সুযোগ পাননি। তিন মাস ধরে বদলি কার্যক্রম চালু থাকার কথা থাকলেও এর আগেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে সার্ভার। দুই শিক্ষকের আপসে বদলির সুযোগও বন্ধ হয়ে গেছে এই পদ্ধতিতে। এভাবে ডিজিটাল বদলির কারণে একদিকে শিক্ষকের হয়রানি বেড়েছে, আরেকদিকে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে ধরনাও দিতে হচ্ছে।

ঠাকুরগাঁওয়ের উল্লিখিত সনগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বদলির ঘটনা থেকে অভিযোগ এসেছে, যিনি যোগাযোগ করতে পেরেছেন তারই বদলি হয়েছে। ধরনা না দিলে বদলির সুযোগ মিলছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। এভাবে সারা দেশে ১ হাজার ৩১৬ জনের বদলি নিষ্পত্তি হয়নি। এসব ঘটনায় হতবাক ও ক্ষুব্ধ সাধারণ শিক্ষকরা। কিন্তু এসব তুঘলকি কাণ্ডের দায় সিনিয়র কর্মকর্তারা চাপাচ্ছেন জুনিয়রদের ওপর।

আর জুনিয়ররা চাপাচ্ছেন সিনিয়রের ওপর। শেষ পর্যন্ত সারা দেশের ৯৫ উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে (ডিইও) শোকজ করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই)।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ডিপিই মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত বলেন, সফটওয়্যারে কোনো ধরনের ত্রুটি ধরা পড়েনি। এটি জাতীয়ভাবে প্রবর্তনের আগে দীর্ঘ সময় নিয়ে পাইলটিং (পরীক্ষামূলক চালু) করা হয়েছিল। তাছাড়া নীতিমালার আলোকে সফটওয়্যারটি তৈরি করা। সুতরাং যেসব আবেদন পেন্ডিং (নিষ্পত্তি না করা) রয়ে গেছে, সেগুলোর ভিন্ন কারণ থাকতে পারে।

সেই কারণ জানতেই সংশ্লিষ্ট শিক্ষা কর্মকর্তাদের শোকজ করা হয়েছে। যাদের কাছে সন্তোষজনক উত্তর পাওয়া যাবে না, তাদের দ্বিতীয় দফায় শোকজ করা হবে। কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃত পেন্ডিং রাখার ঘটনা পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গত নভেম্বরের শেষদিকে এবং জানুয়ারির প্রথমদিকে দুই দফায় বদলির আবেদন নেওয়া হয় অনলাইনে।

তখন প্রধান ও সহকারী উভয় ধরনের শিক্ষক আবেদন করেন। প্রথম দফায় ২৫ হাজার ৩৬৮ এবং পরের দফায় ২৩ হাজার ৬৪৮ জন আবেদন করেন। এর মধ্যে দ্বিতীয় দফায় প্রধান শিক্ষকরা আবেদন করতে পারেননি। প্রথম দফায় ৪ হাজার ১৮১ জন প্রধান শিক্ষক আবেদন করেছেন।

আগামী সপ্তাহে আন্তঃজেলা ও বিভাগে বদলির আবেদন নেওয়া হবে। এ লক্ষ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বৈঠক ডাকা হয়েছে। যদিও একটি সূত্র জানিয়েছে, বৈঠকটি সোমবার হতে পারে।

ডিপিই সূত্র জানায়, নিষ্পত্তি না হওয়া আবেদনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হবিগঞ্জ জেলায়। এছাড়া সুনামগঞ্জে ১৮৭, ভোলায় ৭৩, ময়মনসিংহে ৩০, রংপুরে ১৮, কুড়িগ্রামে ১৮, পিরোজপুরে ২৭, বরগুনায় ২৯, নেয়াখালীতে ৩৭, ঢাকায় ৯টিসহ সারা দেশে ১৩১৬ জনের আবেদন পেন্ডিং রাখা হয়। আগের মতোই জেলা ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এই ঘটনা ঘটেছে।

অর্থাৎ, যারা যোগাযোগ করেননি, তাদের বদলি করা হয়নি। সাভারে বাউনিয়া আলহাজ ফিরোজ কবির সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও এমন একটি ঘটনা আছে। ওই বিদ্যালয়ে মো. রায়হান নামে একজন শিক্ষক জানান, চার বছর তিনি ওই বিদ্যালয়ে কর্মরত আছেন। বদলি হওয়ার সব শর্ত পূরণ হওয়ায় গত ৪ জানুয়ারি তার বাড়ির পাশের একটি বিদ্যালয়ে বদলির জন্য আবেদন করেন। তিনি সিনিয়র হওয়ার পরও সেখানে তাকে না দিয়ে নতুন যোগদান করা জুনিয়র এক শিক্ষকের বদলি দেওয়া হয়েছে।

তিনি আরও জানান, তার আবেদন ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে-এমন খবর পেয়ে সাভারের উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি। তখন তাকে জানানো হয়, এখন কিছু করার নেই। আগে যোগাযোগ করলে বিবেচনা করতেন তিনি। এ নিয়ে অধিদপ্তরে গিয়েও তিনি প্রতিকার পাননি।

জানা যায়, শিক্ষক বদলিতে নিয়ম না মানায় ২ ফেব্রুয়ারি ৯৫ জন কর্মকর্তাকে শোকজ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৪৬ জন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এবং ৪৯ জন উপজেলা/থানা শিক্ষা কর্মকর্তা আছেন। তাদের পরবর্তী তিন কার্যদিবসের মধ্যে জবাব দিতে বলা হলেও ১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১২ জেলা থেকে শোকজের জবাব পাঠানো হয়েছে।

অধিকাংশ জবাবে সার্ভার জটিলতা, ইন্টারনেট সমস্যা, মূল্যায়নে স্বল্প সময় দেওয়া, অসম্পন্ন আবেদন পাঠানোর অভিযোগ তোলা হয়েছে। অনলাইন বদলির পদ্ধতি বুঝতে না পারার কারণও উল্লেখ করা হয়েছে।

হবিগঞ্জ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. গোলাম মওলার সঙ্গে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, বদলির যে কয়টি আবেদন তিনি নিষ্পত্তি করতে পারেননি, এর বেশির ভাগ প্রধান শিক্ষকের। সহকারী শিক্ষকের কিছু আবেদন আটকে আছে। হঠাৎ সার্ভার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তিনি কাজ শেষ করতে পারেননি। ইচ্ছাকৃত কোনো ঘটনা তার পক্ষ থেকে ঘটেনি।

এদিকে মাঠপর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তাদের দাবি, সফটওয়্যারে ত্রুটি আছে। একজন শিক্ষক আবেদনে তিনটি স্কুল পছন্দ দিতে পারেন। এর মধ্যে তারা একটি স্কুলে বদলির সুপারিশ করে ফাইল অগ্রায়ন করেন। কিন্তু দেখা গেছে, তাকে আরেক স্কুলে বদলির আদেশ দেওয়া হয়েছে। আবার সব শর্ত পূরণ করা সত্ত্বেও কাছের স্কুলে সিনিয়র শিক্ষক বদলির আদেশ পানি।

এছাড়া প্রধান শিক্ষকদের বদলির আদেশ উপপরিচালকের স্বাক্ষরে হওয়ার কথা থাকলেও তা উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের স্বাক্ষরে হয়েছে। আগে আপসে শিক্ষকরা বদলি হতে পারতেন। অর্থাৎ, দুইজন শিক্ষক একজন আরেকজনের জায়গায় আপসে বদলি হতে পারতেন। এ পদ্ধতিতে সেই সুযোগ নেই। অথচ এ ধরনের ৪০ শতাংশ বদলি ছিল।

এ প্রসঙ্গে ডিপিইর সিনিয়র সিস্টেম অ্যানালিস্ট প্রকৌশলী অনুজ কুমার রায় বলেন, সফটওয়্যারে কোনো ত্রুটি নেই। বদলি যে ধরনের হোক না কেন, তা বিধিবিধানের আলোকে হবে। সিনিয়রিটি বা বয়স, দূরত্ব নয়, অনেক শর্ত আছে। সফটওয়্যার স্বয়ংক্রিয়ভাবে সব বিশ্লেষণ করে বদলির আদেশ তৈরি করে দেয়। বরং যারা আবেদন নিষ্পত্তি করেননি, সেটা তাদের ত্রুটি। সেটা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত যেটাই হোক।