আল্লাহ কোন জাতির ভাগ্য ততক্ষণ পরিবর্তন করেন না,যতক্ষণ না তারা নিজেরা চেষ্টা করে


সুরা রাদের চতুর্থ আয়াতে বলা হয়েছে, ‘(৪) এবং ভূমির বিভিন্ন খণ্ড পরস্পর সংলগ্ন; তাতে আছে আঙ্গুরের বাগান, শস্যক্ষেত এবং খেজুর গাছ- কতক দুই মূল বা দুই শিরবিশিষ্ট, কতক একশির বা এক মূল-বিশিষ্ট,

সবগুলোকে একই পানি দিয়ে সিঞ্চন করা হয়; এবং আমরা তাদের কোনোটিকে অন্য কয়েক প্রজাতির ওপর প্রাধান্য দিয়ে থাকি। নিশ্চয়ই বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন সম্প্রদায়ের জন্য এতে বহু নিদর্শন রয়েছে।’

একই ফল গাছের নানা ধরনের জাতের কথা এখানে বলা হয়েছে। যেমন, কলা ও খেজুর গাছের কাণ্ড বা মূলের প্রকারভেদ অনুযায়ী সেগুলোর ফলও হয় ভিন্ন ধরনের। এখানে সম্ভবত দুই ধরনের গাছের মধ্যে জোড়া দেয়া বা কলম করার ক্ষমতার কথাও বলা হচ্ছে। ফলে একই মাটি ও একই মূল থেকে নানা ধরনের ফল পাওয়া সম্ভব। একই পানি ও বাতাস ভোগ করেও বিচিত্রময় ফল দেয়া সত্যিই বিস্ময়কর ঘটনা!

সুরা রাদের পঞ্চম ও ষষ্ঠ আয়াতে বলা হয়েছে:

‘(৫) এবং তোমরা যদি বিস্মিত হও, তবে বিস্ময়ের বিষয় তাদের এই কথা- ‘যখন আমরা মাটিতে পরিণত হব, তখন কি আবার নতুন করে আমাদের সৃষ্টি করা হবে?’ তারাই তাদের প্রতিপালককে অস্বীকার করে এবং তাদের কাঁধে থাকবে শৃঙ্খলগুলো; তারাই জাহান্নামী হবে, সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে। (৬) এবং (হে রাসূল!) তারা তোমার কাছে কল্যাণের আগেই শাস্তি বা আজাব ত্বরান্বিত করতে চায়, অথচ তাদের আগে শিক্ষণীয় বহু শাস্তির দৃষ্টান্ত রয়েছে। এবং নিশ্চয় তোমার প্রতিপালক মানুষের প্রতি তাদের অবিচার সত্ত্বেও অতিশয় ক্ষমাশীল এবং নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক অতি কঠোর শাস্তিদাতাও।’

মানুষ হচ্ছে বুদ্ধি ও বিবেক-সম্পন্ন সত্তা। তারা কোনো অবাস্তব বা যুক্তিহীন কথা শুনলে বিস্মিত হয়। তাই মৃত্যুর পর মানুষের দেহ মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়ার পরও সেই মানুষকে মহান আল্লাহ কিভাবে আগের মতই একই অবয়বে ও একই রক্ত-মাংসের সেই কাঠামোতেই জীবিত করবেন- কাফিরদের এমন কথাকে মহান আল্লাহ বিস্ময়কর বলে অভিহিত করেছেন। কারণ, এ ধরনের মানুষের চিন্তা করা উচিত যে, তার দেহকে মহান আল্লাহ অতীতের কোন্ সত্তা বা বীর্য থেকে সৃষ্টি করেছিলেন এবং সেই শুক্র এসেছিল মাটির সঙ্গে সম্পর্কিত উদ্ভিদজাত কোন্ কোন্ খাদ্য, বা গাছের ফল থেকে? তা ছাড়া মহান আল্লাহ সম্পূর্ণ অস্তিত্বহীন ছিল এমন সৃষ্টিকে যদি অনস্তিত্ব থেকে সৃষ্টি করতে পারেন প্রথমবার তাহলে দ্বিতীয়বারও কেনো তা করতে পারবেন না?

কাফিররা এটাও বলে, মানুষ মারা যাওয়ার পর তার সত্তা ধ্বংস হয়ে যায় বলে তাকে নতুন করে রক্ত ও গোশতের আবরণে আবারও সৃষ্টি করার তথা নতুন পোশাক পরিয়ে আবারও জন্ম দেয়ার কী দরকার?

এর উত্তর হল, মানুষের সত্তা তো কেবলই তার দেহ নয়, তার তো আত্মাও রয়েছে, তাই তার দেহ ধ্বংস হয়ে গেলেই তো সে আর পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায় না। বরং মানুষের মূল সত্তা হল তার রুহ বা আত্মা কিংবা প্রাণ যা মানুষের শরীরকে নানা লক্ষ্য পূরণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করত মাত্র। পুনরুত্থানের সময় মৃত্যুর ফেরেশতার কাছে জমা-থাকা সেই প্রাণ আবারও সেই একই ধরণের রক্ত-গোশতের দেহে যুক্ত করা হলে মানুষটি আবারও ঠিক সেই আগের মানুষেই পরিণত হবে।

সুরা রাদের অনেক বাক্যে প্রাকৃতিক অনেক বিষয়ের রহস্য তুলে ধরা হয়েছে বলে এই বাক্যগুলোকে পবিত্র কুরআনের বৈজ্ঞানিক মু’জিজার নিদর্শন বলে মনে করা হয়। যেমন, এই সুরার ১১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন,

‘(১১) তার (মানুষের) জন্য তার সম্মুখভাগে ও পশ্চাৎভাগে সার্বক্ষণিক প্রহরী নিযুক্ত রয়েছে, যে আল্লাহর নির্দেশে তাকে (অবধারিত নয় এমন বিপদ থেকে) রক্ষা করে; এবং আল্লাহ কোন জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজ অবস্থা নিজে পরিবর্তন করে; আর আল্লাহ যখন কোন জাতিকে (তাদের কাজের জন্য) শাস্তিদানের ইচ্ছা করেন তখন কেউ তা প্রতিরোধ করতে পারে না, আর তিনি ছাড়া তাদের কোনো অভিভাবক নেই।’

মহান আল্লাহর নিযুক্ত প্রহরীরা দিন ও রাতে মানুষকে অনেক বিপদ থেকে রক্ষা করছে। মানুষের জীবনে বিপদ ও দুর্ভোগের সংখ্যা অনেক। বিশেষ করে, শিশুদের সামনে সব সময়ই বিপদ ওৎ পেতে থাকে। আমরা কখনও কখনও অনুভব করি যে কোনো এক শক্তি যেন ঢাল হয়ে প্রাণঘাতী নানা বিপদ থেকে আমাদের রক্ষা করছে। মুসলমানদের ইমাম ও মহান পথ-প্রদর্শকদের বর্ণনায় এ বিষয়ের স্বীকৃতি রয়েছে। যেমন, ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেছেন, ‘এমন কোনো ব্যক্তি নেই যাকে দু’জন ফেরেশতা হেফাজত করছে না। কিন্তু যখন বিপদ বা দূর্ঘটনার ব্যাপারে মহান আল্লাহর স্পষ্ট নির্দেশ চলে আসে তখন ফেরেশতারা আল্লাহর নির্দেশই মেনে নেন।’

তবে এখানে এটাও মনে রাখা দরকার, দু’জন ফেরেশতা সব সময়ই মানুষকে নানা বিপদ থেকে রক্ষা করছেন বলে এটা ভাবার সুযোগ নেই যে ব্যাপারটি নিঃশর্ত এবং মানুষ কোনো উঁচু স্থান থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করতে চাইলেও বা অন্য কোনো আত্মঘাতী পদক্ষেপ নিতে চাইলেও মহান আল্লাহ ও তার ফেরেশতারা তাকে রক্ষা করবেন! আর যখন মহান আল্লাহই কোনো জাতিকে শাস্তি দেয়ার নির্দেশ দেন তখন ফেরেশতারা মানুষের জন্য প্রহরার কাজ করে না।

‘আল্লাহ কোনো জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না সেই জাতি নিজেই নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করে’-সুরা রাদের এই আয়াতটি একটি চিরন্তন ও সামগ্রীক মূল নীতি। সামাজিক পরিবর্তন সংক্রান্ত ইসলামের এই নীতি আমাদের বলছে যে, যে কোনো পরিবর্তনের জন্য প্রথমে মানুষকেই উদ্যোগ নিতে হবে। মানুষ তার ভুল পদক্ষেপ বা সঠিক কাজের কারণেই দূর্ভাগ্য ও সৌভাগ্যের পথ প্রশস্ত করে। মহান আল্লাহ কোনো জাতিকে বিনা অপরাধে শাস্তি দেন না এবং কোনো জাতিকে সেই জাতির সৎকাজের কোনো পটভূমি ছাড়াই বিশেষ অনুগ্রহ বা দয়া করেন না। কোনো ব্যক্তি বা জাতি যখন অন্তর থেকেই নিজেকে রক্ষা করতে চায় ও পরিবর্তিত হতে চায় তখন তারা আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ লাভ করে। অন্য কথায় যে কোনো বাহ্যিক পরিবর্তনের জন্য আগে মানুষের অন্তরেও পরিবর্তন আসতে হবে।#