কেমন ছিল রাসুল (সা.)-এর যুগের বিচারব্যবস্থা

ইসলামপূর্ব যুগে আরবে একক কোনো শাসন বা রাষ্ট্র ব্যবস্থা ছিল না। ফলে আরব উপদ্বীপে কোনো বিচারব্যবস্থাও তখন গড়ে ওঠেনি।

গোত্রীয় শাসন কার্যকর ছিল। গোত্রপ্রধানরা ছিলেন তাদের নিয়ন্তা, পরিচালক ও বিচারক। তাঁরাই আইন প্রণয়ন ও কার্যকর করতেন আরব সমাজে। গোত্রীয় আইন প্রণয়নে ব্যক্তির সিদ্ধান্ত ও সম্মিলিত সিদ্ধান্ত দুটি প্রচলনই ছিল। গোত্রপ্রধান ও নেতারা নিজেদের অভিজ্ঞতা, বিচক্ষণতা, অতীত ইতিহাস, সামাজিক রীতি ও মূল্যবোধের আলোকে আইন প্রণয়ন করতেন। স্বগোত্রীয় লোকেরা তা পালন করত। গোটা আরব উপদ্বীপে এমন অসংখ্য গোত্রীয় শাসন কার্যকর ছিল। এর বাইরে পশু পালন, পানির উৎস সন্ধান, তীর্থযাত্রা ও ব্যাবসায়িক কাফেলার চলাচল নির্বিঘ্ন করতে এবং গোত্রীয় সংঘাত নিরসনে আন্তর্গোত্রীয় কিছু আইনও আরব সমাজে কার্যকর ছিল। এসব আইনের ভিত্তি ছিল আন্তর্গোত্রীয় চুক্তিসমূহ।
তবে এসব আইনের কার্যকারিতা ও প্রয়োগ নির্ভর করত সার্বিক পরিস্থিতির ওপর। যুদ্ধাবস্থায় আন্তর্গোত্রীয় আইনও কার্যকারিতা হারাত কখনো কখনো। আইন শাসন ও সামাজিক শৃঙ্খলার দৃষ্টিতে বিচার করলে ইসলামপূর্ব আরব ছিল চরম নৈরাজ্যপূর্ণ একটি সমাজ।
এমন পরিস্থিতিতে সাম্য ও সুবিচারের বাণী নিয়ে ইসলামের আগমন হয় আরব উপদ্বীপে। ইসলামী আইন ও বিচার ব্যবস্থার মূলেই রয়েছে মানুষের জীবন, সম্পদ, সম্ভ্রম, মনন ও বংশপরম্পরার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আল্লাহ তাআলা মানুষের ভেতর সুবিচার প্রতিষ্ঠাকে কোরআন নাজিলের অন্যতম উদ্দেশ্য হিসেবেও উল্লেখ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আমি আপনার ওপর অবতীর্ণ করেছি সত্য কিতাব; যেন আল্লাহ আপনাকে যা হৃদয়াঙ্গম করিয়েছেন তার মাধ্যমে মানুষের ভেতর ন্যায়বিচার করেন। আপনি বিশ্বাসঘাতকদের পক্ষে বিতর্ককারী হবেন না। ’ (সুরা নিসা, আয়াত : ১০৫)

তবে ইসলামী বিচার ব্যবস্থার সুফল পেতে আরবদের অপেক্ষা করতে হয় আরো ১০ বছর। রাসুলুল্লাহ (সা.) হিজরত করার পর মদিনায় ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে ইসলামী বিচার ব্যবস্থা প্রায়োগিক ভিত্তি পায়। মদিনার অন্য সব কর্মকাণ্ডের মতো বিচারব্যবস্থারও কেন্দ্রে ছিলেন মহানবী (সা.)। মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্রের বিচারকের দায়িত্ব পালন করতেন তিনি। আইন প্রণয়ন, বিচার ও তা বাস্তবায়ন—সব কিছুই তাঁর ওপর ন্যস্ত ছিল। বিশেষত আইন প্রণয়ন ও বিচারকার্য সম্পাদনের কাজ তিনিই করতেন। বাস্তবায়নের দায়িত্ব কখনো কখনো অন্যদের অর্পণ করতেন। ইসলামী আইনবেত্তারা এর পেছনে কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন। যেমন—

এক. মহান আল্লাহর নির্দেশ। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনি তাদের মাঝে বিচার করুন—আল্লাহ যে বিধান অবতীর্ণ করেছেন তার মাধ্যমে। আপনার কাছে আগত সত্য পরিহার করে তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করবেন না। ’ (সুরা মায়েদা, আয়াত : ৪৮)

দুই. নির্ভুল বিচার শুধু তাঁর মাধ্যমেই সম্ভব ছিল। কেননা তিনি আল্লাহ কর্তৃক ওহিপ্রাপ্ত ছিলেন।

তিন. আল্লাহর নবী হিসেবে তিনি সর্বোচ্চ যোগ্যতা ও মর্যাদার অধিকারী।

চার. সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষা ও নেতৃত্ব সুদৃঢ় করতে বিচারিক ক্ষমতা রাসুল (সা.)-এর হাতে রাখা গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

পাঁচ. রাসুল (সা.)-এর আনুগত্য ছিল ঈমানের অপরিহার্য দাবি। তাই বিচারক হিসেবে তাঁর সিদ্ধান্তের কার্যকারিতা অন্য যে কারো চেয়ে বেশি ছিল।

ছয়. মুসলিমরা প্রতিনিয়ত এমন সব বিষয়ের মুখোমুখি হচ্ছিল, যে সম্পর্কে ইসলামের কোনো বিধান তাদের জানা ছিল না বা সে সম্পর্কে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের কোনো নির্দেশনা তাদের জানা ছিল না। তাই রাসুল (সা.)-ই ছিলেন বিচারকার্যের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি।

মদিনার ইসলামী সমাজের সাধারণ নিয়ম ছিল সাহাবায়ে কেরাম (রা.) যখন কোনো সমস্যা ও সংকটের মুখোমুখি হতেন, কোনো বিবাদ ও বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা তৈরি হতো, তাঁরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে যেতেন। তিনি ঐশী নির্দেশনা ও তাঁর জ্ঞান-প্রজ্ঞার আলোকে এর সমাধান করতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বিচারকার্য বিশ্লেষণ করলে দুই রকমের বিচারিক কাজের সন্ধান পাওয়া যায়।

এক. বিষয়টি সরাসরি মানুষের ঈমান ও ইসলামের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এমন বিষয়ে মহানবী (সা.) সাধারণত ওহির অনুসরণ করতেন বা ওহির জন্য অপেক্ষা করতেন। ওহি অবতীর্ণ হওয়ার পর আল্লাহর বিধান প্রার্থীদের শুনিয়ে দিতেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর ভেতর ‘শরিয়ত প্রণেতা’-এর বৈশিষ্ট্য প্রবল ছিল।

দুই. এমন বিষয়, যা সরাসরি মানুষের ঈমান ও আমলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। বরং তাতে পার্থিব জীবনের অংশই বেশি। এমন বিষয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) কখনো ইজতেহাদ করতেন। ব্যক্তিগত মত প্রকাশ করতেন। এ ক্ষেত্রে কখনো কখনো তাঁর ভেতর ‘কাদি’ বা বিচারকের বৈশিষ্ট্য প্রাধান্য পেত।

প্রথম প্রকার বিধান মান্য করা মুসলমানের জন্য সর্বাবস্থায় আবশ্যক। দ্বিতীয় প্রকার বিধানে রাসুলুল্লাহ (সা.) কখনো অবকাশ দিতেন। উম্মে সালমা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, উত্তরাধিকার নিয়ে বিবাদকারী দুই ব্যক্তি এলো। কিন্তু তাদের কারো কাছে কোনো প্রমাণ ছিল না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘তোমরা আল্লাহর রাসু