ক্ষুধা আর অত্যাচারিত শিউলীর এমবিবিএস পাশ

আনিসুজ্জামান •

ভাতের কষ্ট কী? সেটা আমি ভালো করেই জানি। কারণ আমার আব্বা ছিলেন একজন হতদরিদ্র চায়ের দোকানি।

নিজেদের সামান্য জমিও নেই। এই পরিবারে থেকে চিকিৎসক পাশ করার কথা তো স্বপ্নেও ভাবিনি, কারণ আমার এসএসসি পাশ করারও সামর্থ্য ছিল না। কিন্তু অবিশ্বাস্য মনে হলেও বাস্তব সত্য যে, সমাজ সৃষ্ট সকল প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে আমি ইতিমধ্যে এমবিবিএস পাশ করেছি। আমার এই সফলতার পুরো গল্প জুড়ে আছেন একজন সফল সমাজসেবক মোহাম্মদ শামসুদ্দিন স্যার। এভাবেই দারিদ্র্যতাকে পেছনে ফেলে সাফল্যের নেপথ্যের কথাগুলো এভাবেই তুলে ধরেন মুক্তারপুর খলিফাপাড়া গ্রামের মোছা. শিউলী আক্তার।

শিউলী সম্প্রতি বেসরকারি বারিন্দ মেডিক্যাল কলেজ, রাজশাহী থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করেছেন। এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করতে একেক জন শিক্ষার্থীর সেশন ফি-সহ অন্তত ৩০ লাখ টাকার প্রয়োজন। তবে শিউলীকে একটি টাকাও দিতে হয়নি সেখানে লেখাপড়া করতে। অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে শিউলীকে এই পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন বারিন্দ মেডিক্যাল কলেজের ব্যবস্হাপনা পরিচালক ও বিশিষ্ট সমাজসেবক মোহাম্মদ শামসুদ্দিন। চারঘাট উপজেলার সদরহ ট্রাফিক মোড়ে শিউলীর বাবার একটি চায়ের দোকান ছিল। তাদের পাঁচ ভাই-বোনকে নিয়ে সেই দোকানের আয়ে খুঁড়িয়ে খঁুড়িয়ে চলত বাবা-মায়ের কষ্টের সংসার। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে সেই দোকানটি এক রাতের আঁধারে পুড়িয়ে দেয় স্হানীয় দুর্বৃত্তরা। এরপর তার বাবা স্ট্রোক করেন। দিনমজুর চার ভাইয়ের সংসারে শিউলী যেন বোঝা। এমন অভাব-অনটনের মধ্যেই তার শিক্ষাজীবন শুরু। একদিন পড়ার জন্য মাকে সঙ্গে নিয়ে একজন শিক্ষকের বাসায় গিয়েছিলেন। সেখানে তার গৃহ-পরিচারিকা মাকে ভাঙা চেয়ারে বসতে দেয়। এ ঘটনায় শিউলীর মনে জেদ হয়েছিল, যে কোনো মূল্যে পড়াশোনা চালিয়ে যাবেন এবং মানুষের মতো মানুষ হবেন। ৫ম ও ৮ম শ্রেণিতে শিউলী বৃত্তি পায়। সেই বৃত্তির টাকায় চালিয়ে যেতে হয় পড়াশোনা।

শিউলী আক্ষেপ করে বলেন, শিশু বয়স থেকেই তিনি সমাজের যেখানেই গেছেন, সেখানেই দেখেছেন অর্থের প্রয়োজনীয়তা এবং ধনী ও দরিদ্রের বৈষম্য। অভাব-অনটন থেকে মুক্তির আশায় ৯ম শ্রেণিতে পড়ার সময় শিউলীর বিয়ে দেয় পরিবার। বাবা-মায়ের সংসার ছেড়ে এসে শিউলী ভেবেছিলেন, স্বামীর নতুন সংসারে হয়তো তার ভাতের কষ্টটা থাকবে না। কিন্তু নিয়তি যেন এখানেও নিষ্ঠুর হলো। শ্বশুরবাড়িতে ভাতের কষ্ট না থাকলেও শ্বশুর-শাশুড়ি তার লেখাপড়ায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলেন। টানাপোড়েনের মাঝেই ২০১১ সালে শিউলী এসএসসিতে গোল্ডেন ‘এ’ প্লাস পেয়ে পাশ করেন।

রাজশাহী কলেজে ভর্তির সুযোগ পেলেও যাতায়াত খরচের টাকার কথা ভেবে ভর্তি হননি শিউলী। শ্বশুরবাড়ি কাজলার কাছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল ও কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হন। তখন তার বেকার স্বামী রাশেদুর রহমান বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কতৃ‌র্পক্ষতে (বিএমডিএ) মাসিক ১ হাজার ৫০০ টাকার একটি কাজ পান। সামান্য বেতনের চাকুরি স্বামী স্ত্রীকে নিয়ে ভাড়া বাড়িতে ওঠেন। এভাবে একরকম যুদ্ধ করে ২০১৩ সালের এইচএসসিতেও সকল বিষয়ে ‘এ’ প্লাস পান। ‘স্বপ্ন’ ছিল মেডিক্যালে পড়বেন। সরকারি মেডিক্যাল কলেজে চান্স হলো না। তবে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির মতো রেজাল্ট হলো। এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর স্হানীয় একটি পত্রিকায় খবর হয়েছিল ‘অর্থের অভাবে কি শিউলী ফুটবে না?’ খবর শুনে অনেকেই শিউলীকে সহায়তার জন্য ছুটে গেলেন। কিন্তু তিনি বিবাহিত মেয়ে শোনার পর কেউ সাড়া দেননি।

শিউলী বলে যান, ‘এটাই ছিল তার জীবনের সবচেয়ে হতাশার সময়। অনেকটা তীরে এসে তরি (নৌকা) ডুবে যাওয়ার মতো দশা। এর মধ্যে স্বামীর মাসিক বেতন বেড়ে ৩ হাজার ৬০০ টাকা হয়। এদিকে স্হানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত ঐ খবরটি-ই যেন শিউলীর ভাগ্যের চাকা খুলে যায়। খবরটি নজরে আসে বিশিষ্ট সমাজসেবক মোহাম্মদ শামসুদ্দিনের। একদিন বারিন্দ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ব্যবস্হাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামসুদ্দিন শিউলীর খবর নেওয়ার জন্য গাড়ি পাঠান। সব শুনে শামসুদ্দিন স্যারই তাকে বারিন্দ মেডিক্যাল কলেজে ‘ফ্রি’ ভর্তির ব্যবস্হা করে দেন। ২০১৫ সালের ৭ জুন ছেলে সন্তানের জন্ম দেন শিউলি। ১৫ দিন পর থেকেই পেটে বেল্ট বেঁধে ক্লাসে যাওয়া শুরু করেন শিউলী। একটাই লক্ষ্য, ডাক্তারি পড়া যে কোনো মূল্যে শেষ করতেই হবে। মোহাম্মদ শামসুদ্দিনের আশীর্বাদেই চিকিত্সক হতে পেরেছেন বলে জানান শিউলী। তিনি আরো জানান, মোহাম্মদ শামসুদ্দিন স্যার শুধু তাকে লেখাপড়া করিয়েছেন তাই-ই নয়, ২০১৬ সালে শিউলীর স্বামী রাশেদুর রহমানকেও নিজ প্রতিষ্ঠান বারিন্দ মেডিক্যাল কলেজে চাকরি দিয়েছেন।

আবেগে আল্পুত শিউলী বলেন, তার সেমিস্টারে সহপাঠীদের পরিবারের তুলনায় তার পরিবার আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকায় সবাই তাকে নানাভাবে হেয় করেছেন। কেউ তার সঙ্গে মিশত না। স্বামীকে চাকরি দেওয়ার ঘটনা জানাজানির পর কর্মচারীর স্ত্রী বলে তাকে ব্যাচের কেউ স্টাডি গ্রুপেও নেয়নি। তিনি প্রথম বেঞ্চে বসলে, ঐ বেঞ্চে আর কেউ বসতেন না। পেছনের বেঞ্চে বসলেও একাই বসতে হতো তাকে। ক্যান্টিনেও একই অবস্হা হতো। বিভিন্ন সময় তাকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা, তামাশাও করত সহপাঠীরা। এমনও দিন গেছে সহপাঠীদের মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে কাঁদতে কাঁদতে এমডি স্যারের কাছে গেছেন শিউলী। তখন এমডি তাকে সান্তনা ও উত্সাহ দিয়েছেন।

শিউলী বলেন, এমডি স্যার এভাবে আরো অনেক অসহায় শিক্ষার্থীর জীবন পালটে দিয়েছেন। আজীবন তিনি আমার বাবার জায়গায় থাকবেন।’ তবে শিউলী তার স্বামী রাশেদুর রহমানকে সবসময় বন্ধুর মতো পাশে পেয়েছেন। শিউলির ইচ্ছা ইন্টার্নশিপ শেষে দরিদ্র মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করবেন। ভেবে রেখেছেন, গরিব ও অসহায় মানুষের চিকিত্সাসেবা দেবেন বিনামূল্যে।