গাজার হাসপাতালে বর্বর ইসরায়েলি হামলা, যেভাবে দেখছে বিশ্ব

আন্তর্জাতিক ডেস্ক :


গাজার হাসপাতালে বর্বর ইসরায়েলি হামলা, যেভাবে দেখছে বিশ্ব
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার একটি হাসপাতালে ইসরায়েলের ভয়াবহ হামলার ঘটনায় বিশ্বজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডের কর্তৃপক্ষের মতে, গাজার আল-আহলি আরব হাসপাতালে ইসরায়েলি বিমান হামলায় কমপক্ষে ৫০০ জন নিহত হয়েছেন।

বিশ্বের একাধিক রাষ্ট্রনেতা ইসরায়েলি এই হামলার নিন্দা জানিয়েছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই হামলায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এবং হাসপাতালে হওয়া এই হামলাকে ‘ভয়াবহ এবং একেবারেই অগ্রহণযোগ্য’ বলে অভিহিত করেছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো।

ফিলিস্তিনির অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার ওই হাসপাতালে মঙ্গলবার ভয়াবহ হামলা চালায় ইসরায়েল। ওই এক হামলায় একসঙ্গে ৫০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলে জানায় গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

আল-আহলি আরব নামের ওই হাসপাতালটিতে অসংখ্য আহত ও অসুস্থ মানুষ চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। এছাড়া দখলদার ইসরায়েলিদের হামলা থেকে বাঁচতেও অনেক মানুষ ‘নিরাপদ আশ্রয়’ ভেবে হাসপাতালটিতে অবস্থান নিয়েছিলেন।

গাজার হামাস নিয়ন্ত্রিত সরকার হাসপাতালের ওপর এ হামলাকে ‘যুদ্ধাপরাধ’ হিসেবে অভিহিত করেছে। গত ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েলি বাহিনীর নির্বিচার বিমান হামলায় মঙ্গলবার পর্যন্ত ৩ হাজার ফিলিস্তিনির মৃত্যুর তথ্য জানিয়েছিল হামাস। এরমধ্যেই হাসপাতালে চালানো হলো ভয়াবহ হামলা।

সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে, ওই হাসপাতালটির একটি হলরুমে কয়েকশ বাস্তুচ্যুত মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন। মূলত বিমান হামলা থেকে বাঁচতেই হাসপাতালে গিয়েছিলেন তারা। তবে সেখানেও চালানো হয় ইসরায়েলি নৃশংসতা।

এখানে হামলার পরপরই জানানো কয়েকটি দেশ ও সংস্থার প্রতিক্রিয়া তুলে ধরা হলো:

ফিলিস্তিন
গাজা উপত্যকার আল-আহলি হাসপাতালে ইসরায়েলের ভয়াবহ বোমা হামলার পর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। টিভিতে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেছেন, হাসপাতালে হামলার মাধ্যমে ইসরায়েল চূড়ান্ত সীমা অতিক্রম করেছে।

ওই ভাষণে আব্বাস বলেন, ‘হাসপাতালের এ হামলাটি জঘন্য যুদ্ধ গণহত্যা। এটি সহ্য করা যায় না। ইসরায়েল চূড়ান্ত সীমা অতিক্রম করেছে। আমরা আমাদের ভূমি ছেড়ে কোথাও যাবো না এবং কাউকে আমাদের উচ্ছেদও করতে দেবো না।’

এছাড়া প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের একজন মুখপাত্র হাসপাতালে বিমান হামলাকে গণহত্যা এবং মানবিক বিপর্যয় বলে নিন্দা করেছেন।

জর্ডান
মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে, জর্ডানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইসরায়েলের হামলার তীব্র নিন্দা করেছে এবং ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের জন্য আন্তর্জাতিক সুরক্ষা ও চলমান যুদ্ধের অবসানের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছে।

জর্ডানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ বলেছেন, গাজার হাসপাতালে ইসরায়েলের বোমা হামলা একটি ‘গণহত্যা’ এবং ‘যুদ্ধাপরাধ’। এটি সম্পর্কে কেউ নীরব থাকতে পারে না।

এছাড়া অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার হাসপাতালে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর বর্বরোচিত হামলার প্রতিবাদে— যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সফর বাতিল করে দিয়েছে জর্ডান। বুধবার জর্ডানে যাওয়ার কথা ছিল বাইডেনের।

এ সফরে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস, মিশরের প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ এল-সিসি এবং জর্ডানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ —এর সঙ্গে বৈঠক করতেন বাইডেন। সেখানে হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করার কথা ছিল তাদের।

জর্ডানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আয়মান সাফাদি বলেছেন, বাইডেনের সঙ্গে এ বৈঠক বাতিল করা হয়েছে; সঙ্গে বাইডেনের সফরও।

মিশর
অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার হাসপাতালে ইসরায়েলি হামলার ঘটনায় ‘কঠোর ভাষায়’ নিন্দা জানিয়েছে মিশর। মিশরীয় সরকার একটি বিবৃতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে এবং গাজায় মানবাধিকারের আরও লঙ্ঘন প্রতিরোধ করার আহ্বান জানিয়েছে।

কাতার
কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, গাজা উপত্যকার হাসপাতালে ইসরায়েলি বোমা হামলা ওই অঞ্চলে চলমান উত্তেজনা আরও বিপজ্জনকভাবে বৃদ্ধি করবে।

মন্ত্রণালয়ের দেওয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘হাসপাতাল, স্কুল এবং জন সমাগম বেশি হয় এমন স্থানগুলোকে লক্ষ্য করে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি হামলার সম্প্রসারণ সংঘাতের মাত্রা বিপজ্জনকভাবে বৃদ্ধি করেছে।’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)
গাজা উপত্যকার হাসপাতালে ইসরায়েলি বোমা হামলার নিন্দা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।

জাতিসংঘের এই স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রোস আধানম গেব্রেইয়েসুস সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্স-এ বলেছেন, ডব্লিউএইচও আল আহলি আরব হাসপাতালে হামলার তীব্র নিন্দা করছে। প্রাথমিকভাবে যেসব খবর পাওয়া যাচ্ছে তাতে হাসপাতালে হওয়া এই হামলায় শত শত মানুষের প্রাণহানি এবং আহতের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা অবিলম্বে বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার পাশাপাশি গাজার ফিলিস্তিনিদের বাড়ি-ঘর ছেড়ে চলে যাওয়ার বিষয়ে যেসব আদেশ দেওয়া হয়েছে সেগুলো প্রত্যাহার করার আহ্বান জানাই।’

আরব লীগ
অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডের হাসপাতালে ইসরায়েলি হামলার ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে আরব লীগ। এই গোষ্ঠটির প্রধান আহমেদ আবুল গেইত বলেছেন, এই হামলার প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট বিপর্যয় অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে আন্তর্জাতিক নেতাদের।

সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়া পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘কোন শয়তানসুলভ ও পৈশাচিক মন ইচ্ছাকৃতভাবে একটি হাসপাতাল এবং সেখানে অবস্থানরত অরক্ষিত মানুষের ওপর বোমাবর্ষণ করতে পারে? আরব দেশগুলো যুদ্ধাপরাধের এসব ঘটনা নথিভুক্ত করবে এবং অপরাধীরা তাদের কর্ম থেকে রেহাই পাবে না।’

তুরস্ক
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়া এক বিবৃতিতে গাজায় হাসপাতালে ইসরায়েলি হামলার নিন্দা জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘নারী, শিশু এবং নিরপরাধ বেসামরিক নাগরিকরা অবস্থান করছেন এমন একটি হাসপাতালে হামলা করার এই ঘটনাটি ইসরায়েলের মৌলিক মানবিক মূল্যবোধ-বর্জিত কর্মকাণ্ডের সর্বশেষ উদাহরণ।’

তিনি আরও বলেন, ‘গাজার ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে এই নজিরবিহীন বর্বরতা বন্ধে পদক্ষেপ নিতে আমি সকলকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।’

কানাডা
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার একটি হাসপাতালে ইসরায়েলের ভয়াবহ হামলার ঘটনায় কঠোর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। তিনি এই হামলাকে ‘ভয়াবহ এবং একেবারেই অগ্রহণযোগ্য’ বলে অভিহিত করেছেন।

একইসঙ্গে ইসরায়েলকে যুদ্ধের আইন মেনে চলার গুরুত্বের ওপরও জোর দিয়েছেন তিনি। কানাডা জোর দিয়ে বলেছে, হামাসের বিরুদ্ধে হামলা চালানোর সময় ইসরায়েলকে অবশ্যই আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলতে হবে।

ট্রুডো সাংবাদিকদের বলেন, ‘গাজা থেকে যে খবর আসছে তা ভয়ঙ্কর এবং একেবারেই অগ্রহণযোগ্য… আন্তর্জাতিক আইনকে এ ক্ষেত্রে এবং সব ক্ষেত্রেই সম্মান করা দরকার। যুদ্ধের কিছু নিয়ম রয়েছে এবং যুদ্ধের নামে হাসপাতালে হামলা করা গ্রহণযোগ্য নয়।’

ইরান
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গাজার হাসপাতালে ইসরায়েলের বিমান হামলাকে নিরস্ত্র ও অরক্ষিত মানুষের ওপর হামলা বলে নিন্দা করেছে। ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম এই তথ্য সামনে এনেছে।

এছাড়া গাজা শহরের আল-আহলি আরব হাসপাতালে ‘এক হাজারেরও বেশি নিরপরাধ নারী ও শিশুর ওপর গণহত্যা চালানোর’ পর ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির-আবদুল্লাহিয়ান ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী সাবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্সে তিনি লিখেছেন, ‘হাসপাতালে বোমাবর্ষণ করে এক হাজারেরও বেশি নিরপরাধ নারী ও শিশুকে গণহত্যার মতো ইহুদিবাদী শাসকগোষ্ঠীর ভয়ানক অপরাধের পর আইএসআইএস এর চেয়েও ঘৃণ্য এই ভুয়া শাসনের বিরুদ্ধে মানবতার বৈশ্বিক ঐক্যের সময় এসেছে।’

এতে তিনি আরও বলেন, ‘টাইম ইজ ওভার (সময় শেষ)।’

যুক্তরাষ্ট্র
এদিকে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার একটি হাসপাতালে ভয়াবহ হামলার ঘটনায় ‘ক্ষুব্ধ এবং গভীরভাবে দুঃখিত’ হওয়ার কথা জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। একইসঙ্গে এই ঘটনায় নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের আরও বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করতে বলেছেন তিনি।

ইসরায়েল সফরে যাওয়ার সময় এক বিবৃতিতে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, ‘গাজার আল-আহলি আরব হাসপাতালে বিস্ফোরণ এবং এর ফলে যে ভয়াবহ প্রাণহানি ঘটেছে তাতে আমি ক্ষুব্ধ এবং গভীরভাবে দুঃখিত।’

বাইডেন বলেছেন, হাসপাতালে হামলা ও প্রাণহানির ‘খবর শোনার সাথে সাথে’ তিনি জর্ডানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ এবং ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সাথে কথা বলেছেন। এছাড়া ‘গাজায় ঠিক কী ঘটেছে সে সম্পর্কে জাতীয় নিরাপত্তা দলকে তথ্য সংগ্রহ চালিয়ে যাওয়ার’ নির্দেশও দেওয়ার কথা জানিয়েছে তিনি।

প্রেসিডেন্ট বাইডেন আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র সংঘাতের সময় বেসামরিক মানুষের জীবনের সুরক্ষার জন্য দ্ব্যর্থহীনভাবে দাঁড়িয়েছে এবং আমরা এই ট্র্যাজেডিতে নিহত বা আহত রোগী, চিকিৎসা কর্মী এবং অন্যান্য নিরপরাধ ব্যক্তিদের জন্য শোক জানাই।’

জাতিসংঘ
এদিকে গাজার হাসপাতালে ইসরায়েলি হামলার ‘নিন্দা’ করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। এছাড়া হাসপাতালে হামলা চালিয়ে শত শত মানুষ হত্যার ঘটনায় তিনি আতঙ্কিত বলেও জানিয়েছেন।

সোশ্যাল মিডয়া প্ল্যাটফর্ম এক্সে দেওয়া এক বার্তায় তিনি এই প্রতিক্রিয়া জানান।

এছাড়া মহাসচিবের মুখপাত্র হাসপাতাল এবং ইউনাইটেড নেশনস রিলিফ অ্যান্ড ওয়ার্কস এজেন্সি ফর প্যালেস্টাইন রিফিউজিস ইন দ্য নেয়ার ইস্ট বা ইউএনডব্লিউআরএ-এর স্কুলে হামলার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতিও প্রকাশ করেছেন।

বিবৃতিতে মহাসচিব নিহতদের পরিবারের প্রতি তার আন্তরিক সমবেদনা জানান এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করেন। এছাড়া হাসপাতাল, ক্লিনিক, চিকিৎসা কর্মী এবং জাতিসংঘের প্রাঙ্গণ আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে সুস্পষ্টভাবে সুরক্ষিত বলেও জোর দিয়ে জানান মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস।

আল জাজিরা বলছে, গত সপ্তাহে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার পর এই প্রথম ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলার বিরুদ্ধে ‘নিন্দা’ শব্দটি ব্যবহার করলেন জাতিসংঘ মহাসচিব।