লিবিয়ায় ডাকাতের হাতে প্রাণ হারালেন কক্সবাজারের ইব্রাহিম

এম.জিয়াবুল হক,চকরিয়া :

পরিবারে চার ভাই তিন বোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন ইব্রাহিম খলিল বাবুল। এরই মধ্যে বিয়েও করেছেন তিনি। রয়েছে তিন সন্তান। দুই মেয়ে পড়ছেন ভালো মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। সমাজে অন্য দশজনের মতো বাবুলও দেখছিলেন একদিন তিনিও সত্যিই আলো আধাঁরী কাটাবেন পরিবারের।বদলে দেবেন আর্থিক স্বচ্ছলতা।সেই প্রতিজ্ঞা থেকে আটবছর আগে ভাগ্য ফেরাতে পাড়ি জমান সদুর লিবিয়ায়।

প্রথমে ঠিকমতো কাজ না পেলেও পরবর্তীদের সুদিন ফিরে আসেন বাবুলের ভাগ্যে। এরই মধ্যে দেশটির রাজধানী ত্রিপোলিতে টাইলস মিস্ত্রি হিসেবে কাজও শুরু করছিলেন বাবুল। কয়েকবছরে পরিবারকে দিয়েছেন স্বচ্ছলতার নতুন হাতছানি।

কথা ছিল এবছর দেশে ফিরবেন। একটি নতুন বাড়ি করবেন। ধুমধাম করে বিয়ে দেবেন বড় মেয়েকে। ইতোমধ্যে পরিবার সদস্যরা মেয়ের জন্য পাত্র ঠিক করেছিলেন। কিন্তু গত বুধবার (৯আর্চ) ভোররাতে এক ডাকাতচক্র ত্রিপোলিতে বাসায় ঢুকে বাবুলকে পিটিয়ে ও শ্বাসরোধে হত্যা করেছে। লুটে নিয়ে গেছে টাকা, জিনিসপত্র। আর তাতেই সবকিছু শেষ হয়ে গেল একটি সম্ভাবনাময় পরিবারের ভবিষ্যত। এতিম হয়ে গেলে বাবুলের তিন সন্তান।

নিহত ইব্রাহিম খলিল বাবুল (৪৪) কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার পূর্ব বড় ভেওলা ইউনিয়নের ঈদমনি পশ্চিমপাড়ার মাস্টার হাকিম আলী ও রাবেয়া বেগমের ছেলে। চার ভাই তিন বোনের মধ্যে বাবুল সবার বড়। বৃহস্পতিবার বিকেলে বাড়িতে তাঁর মৃত্যুর খবর পৌঁছলে কান্নার রোল পড়ে যায়। ছেলের মৃত্যুর খবরে নির্বাক হয়ে পড়েছেন বৃদ্ধ বাবা হাকিম আলী।

এরইমধ্যে খবর পেয়ে বাবুলের বাড়িতে আসছেন স্বজনরা, উঠানে বিলাপ করছেন পরিবার সদস্যরা। বাবুলের স্ত্রী বুলবুল আক্তার, তিন মেয়ে উম্মে সালমা মিশু, উম্মে কুলসুম মিলি ও সাত বছরের উম্মে তাওরাত উহিসহ পরিবারের সদস্যরা কাঁদছেন। আর তাদেরকে শান্তনা দিতে চেষ্ঠা করছেন আশপাশের প্রতিবেশি লোকজন। বাবুলের মেয়ে মিশু কক্সবাজার সরকারি কলেজে রসায়নে সম্মান প্রথম বর্ষে, মিলি বান্দরবান সরকারি মহিলা কলেজে একাদশ শ্রেণিতে প্রথম বর্ষে পড়ে।

বাবুলের স্ত্রী বুলবুল আক্তার বলেন, ছোট মেয়ে উহি জন্মের পর তাঁর বাবাকে দেখতে পায়নি। সেই গর্ভে থাকাবস্থায় লিবিয়ায় যান বাবুল। সেখানে যাওয়ার এক মাস পর এই মেয়ের জন্ম হয়। এই জীবনে সে আর তার বাবাকে পাবে না। ’

বুলবুল বলেন, ‘গত বুধবার রাত ১০টার দিকে ভিডিওকলে আমার সঙ্গে কথা বলেন বাবুল। এ সময় বেশ কিছু মাছ নিয়ে কোটার দৃশ্যও দেখান। সেই শেষ কথা, শেষ দেখা!’

লিবিয়া গিয়ে প্রথম দিকে তেমন কাজ পাচ্ছিলেন না। বছর দুয়েক পর সেখান থেকে জানালেন, তিনি খুব ভালো পজিশনে আছেন। দেশে ফিরে আমাদের জন্য নতুন বাড়ি করবেন। ‘ত্রিপোলিতে ডাকাত-সন্ত্রাসীদের বেশ আনাগোনা। এ নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তা করতেন বাবা। তবে আমাদের হাসিখুশিতে রেখেছিলেন।

নিহত বাবুলের সত্তরোর্ধ্ব মা রাবেয়া বেগম বিলাপ করতে করতে বলছিলেন, ‘আমি আর কিছুই চাই না, ছেলের লাশটা ফেরত চাই। সরকার যাতে লাশ দেশে আনতে সহায়তা করে। ’

নিহত বাবুলের ছোট ভাই আতিকুর রহমান জানান, বাবুলের সঙ্গে তিনিও ভিসা নিয়ে লিবিয়ায় গিয়েছিলেন। সেখানে ডাকাত-সন্ত্রাসীরা দিনদুপুরে মানুষ খুন করে উল্লাস করে। সেই দৃশ্য দেখে তাঁর মধ্যে ভয় ঢুকে যায়। তাই তিনি দেশে ফিরে আসেন। তবে বাবুলের মধ্যে সেই ভয় ছিল না। আতিক বলেন, ‘ভাই বললেন, ‘তুই দেশে চলে যা, আমি একবারেই ফিরব।’ সেই ফেরা যে একেবারে না ফেরা, তা কি জানতাম!” বলেই কেঁদে ওঠেন আতিক।

পরিবারের বরাত দিয়ে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন পূর্ব বড় ভেওলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফারহানা আফরিন মুন্না। তিনি বলেন, লিবিয়া থেকে বাবুলের মরদেহটি দেশে ফেরত আনতে চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), থানার ওসিসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আবেদন করা হচ্ছে। আমরা জেনেছি, পাসপোর্টসহ বাবুলের লাশ লিবিয়ার পুলিশ উদ্ধার করেছে। সেখানকার হাসপাতাল মর্গে লাশটি রয়েছে। ’

জানতে চাইলে চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেপি দেওয়ান বলেন, ‘খবরটি আমি শুনেছি। পরিবারকে লিখিত আবেদন দিতে বলা হয়েছে। এরপর মরদেহ দেশে আনতে জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় লিবিয়া দুতাবাসের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে।