নবাগত দায়রা জজের কাছে কক্সবাজারবাসীর প্রত্যাশা

জাহাঙ্গীর আলম, এডভোকেট •

আল্লাহর দরবারে অশেষ শুকরিয়া যে তিনি কক্সবাজারবাসীকে বিশ্বের দীর্ঘতম বালুকাময় সমুদ্র সৈকত দিয়েছেন,পাহাড় দিয়েছেন,সাগর দিয়েছেন,মৎস্য সম্পদ দিয়েছেন ও লবণ দিয়েছেন।

বর্তমান সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা লক্ষ কোটি টাকার মেঘা প্রকল্প কক্সবাজারে বাস্তবায়ন করার ও চলমান রাখার জন্য। প্রায় ১৪ লাখ আশ্রিত রোহিঙ্গা হল এখন কক্সবাজার জেলাবাসীর জন্য প্রধান সমস্যা। দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র ও আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সাহায্য করার জন্য এনজিও ও বিভিন্ন সাহায্য সংস্থার অত্যাধিক অস্থানীয় ও বিদেশী কর্মকর্তা/কর্মচারীদের উপস্থিতির কারণে দেশের অন্যান্য জেলার তুলনায় কক্সবাজার জেলায় দ্রব্যমূল্য অনেক বেশী থাকে।

সে কারণে সরকারী বেসরকারী সংস্থার কর্মকর্তারা বিশেষ ভাতা পেয়ে থাকেন। কিন্তু নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য মূল্যের লাগাতার উর্ধ্বগতির কারণে মারাত্মক অসুবিধায় পড়তে হচ্ছে কক্সবাজার জেলার আমজনতার। বিগত বছর দেড় বছর ধরে বিভিন্ন সত্য-মিথ্যা মামলার আসামীদের জন্য আর একটি অসহনীয় চাপ সৃষ্টি হয়েছে, তা হল জামিননামা সম্পাদনের সাথে অতিরিক্ত টাকা জামানত পরিশোধ করার অপ্রত্যাশিত নতুন নিয়মের কারণে। যা মরার উপর খাড়ার ঘা এর মত।

জামিনের বিষয় বাংলাদেশে প্রচলিত ফৌজদারী কার্যবিধিতে পরিস্কারভাবে উল্লেখ আছে। ১২৫ বছর পূর্বে ফৌজদারী কার্যবিধির জন্ম হওয়ার পর থেকে ১৮৯৮ সালের ফৌজদারী কার্যবিধিতে জামিনের দরখাস্ত হাইকোর্টে বা দায়রা জজ আদালতে বা বিচারিক আদালতে কিভাবে দাখিল করতে হবে,কিভাবে তা শুনানী ও নিস্পত্তি করতে হবে তার বিধিবদ্ধ নিয়ম শত বছর ধরে চালু আছে। কক্সবাজার জেলায়ও ১৫/১/১৯৮৫খ্রিঃ তারিখ থেকে জেলা ও দায়রা জজ আদালত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বিগত ৩৮ বছর ধরে একই নিয়ম চালু ছিল।

কক্সবাজারে দায়রা জজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করা এম,এম,রুহুল আমিন সুপ্রীমকোর্টের প্রধান বিচারপতি হয়েছেন, মোঃ আনোয়ার উল হক আপিল বিভাগের বিচারপতি হয়েছেন, মোঃ এমদাদুল হক ও ভবানী প্রসাদ সিংহও আইনকানুন ভালো জানতেন বলেই নিজ যোগ্যতায় হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি হয়ে অতি সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করে অবসর নিয়েছেন।

কক্সবাজার জেলায় দায়রা জজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ১৫জন বিচারকের কেউ জামিননামার অতিরিক্ত জামানত দিতে আসামীকে নির্দেশ দেওয়ার নজির নাই। বিদায়ী দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল সাহেব মেজর(অব) সিনহা হত্যা মামলার রায় প্রদান করে সর্ব মহলে অতি প্রশংসিত হয়ে রহস্যজনকভাবে তার শেষের দেড় বছর জামিনের সাথে জামানত দেওয়ার আদেশ দেওয়ার নিয়ম চালু করেন কক্সবাজার জেলায়।

জেলা নাজিরের সুত্র দিয়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত মতে তিনি আসামীদের নিকট থেকে ১৮ কোটি ৬০ লক্ষ টাকা জামানত হিসেবে ব্যাংকে জমা করেছেন। আসামীর জামানতের টাকা জরিমানার টাকার মত সরকারের টাকা নয়,জামানতের টাকা আইন অনুযায়ী সরকার ইচ্ছা করলেই খরচ করতে পারবে না। কি উদ্দেশ্যে,কার স্বার্থে টাকাগুলো জমা রাখা হয়েছে? টাকা জামানত রাখার সাথে ন্যায় বিচারের কি সম্পর্ক?

নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের নজিরবিহীন উর্ধ্বগতির সাথে আসামীদের জামিনের জন্য নগদ টাকা জামানত দেওয়ার শর্ত আরোপ করা নজিরবিহীন,বেআইনী ও অমানবিক নয় কি? ভুক্তভোগীদের প্রশ্ন- খাজনা,টেক্স,কোর্টফিস এর অতিরিক্ত নগদ জামানতে জামিন শুধু কক্সবাজার জেলার অধিবাসীদের উপর প্রযোজ্য হবে কেন? কক্সবাজার জেলার আদালতে নগদ টাকা জামানত দিয়ে জামিন দেওয়ার সংবাদটি জনমনে ভুলবার্তা দিচ্ছে। এতে করে স্বভাব-অপরাধীদের মনোবল বৃদ্ধি পাচ্ছে,অপরাধ প্রবণতাও বাড়ছে।

আর,কে,এম রেজার বিরুদ্ধে ২০,১৪৯.৬৬ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দন্ডবিধির ৪০৯/৩৪ ধারা তৎসহ ১৯৪৭ সালের ২নং এক্টের ৫(২) ধারার একটি মামলা হলে আসামী রাজশাহী দায়রা জজ আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের প্রার্থনা করলে নগদ ২০,০০০ টাকা জমা দেওয়ার শর্তে অন্তবর্তীকালীন জামিন মজ্ঞুর করা হয়,অন্যথায় জামিন বাতিল।

আসামী সংক্ষুব্ধ হয়ে সেই আদেশের বিরুদ্ধে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগে ফৌজদারী মিচ মামলা নং ৯০/১৯৮০ দায়ের করলে রুল ইস্যু করা হয়। পরে দরখাস্তকারীর পক্ষে এডভোকেট আমিনুল হক ও রাষ্ট্রপক্ষে ডিএজি মোয়াজ্জেম হোসেনকে শুনানী করে বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরী ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক চৌধুরী গত ২২ জুলাই, ১৯৮০খ্রিঃ তারিখ একটি ঐতিহাসিক রায় প্রদান করেন যা ৩৩ ডিএলআর ১৪৬পৃষ্টায়, ১ বিএলডি ৬৬পৃষ্টায় ও ১ বিএলসি ৩০ পৃষ্টায় প্রকাশিত হয়েছে। বিচারপতিদ্বয়ের প্রদত্ত রায়ে টাকা জমা দেওয়ার শর্ত বাতিল করে জামিনাদেশ বহাল রাখা হয়।

উক্ত রায়ে ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৯৯ ধারা ও ৫১৩ ধারা বিস্তারিত আলোচনা ও ব্যাখ্যা করা হয়। ৪৯৯ ধারায় পরিস্কারভাবে উল্লেখ আছে যে সংশ্লিষ্ট আদালতের সন্তোষ্টি অনুযায়ী নির্ধারিত পরিমাণ অংকের টাকার আসামীর পক্ষে ব্যক্তিগত জামিননামা এবং এক বা একাধিক জামিনদার কর্তৃক সম্পাদিত জামিননামা গ্রহন করে জামিন প্রদানকারী আদালত আসামী কারাগারে থাকলে কারাগারের ভারপ্রাপ্ত অফিসারের বরাবরে আসামীর মুক্তিনামা ইস্যু করবেন এবং তা পাওয়ার পর কারাকর্তৃপক্ষ আসামীকে মুক্তি দেবেন।

৪৯৯ ধারায় নগদ জামানত সম্পর্কে কিছু উল্লেখ নাই। ৫১৩ ধারা আসামীকে জামিনদার প্রদানে অক্ষম হলে জামিননামার পরিবর্তে নির্ধারিত পরিমাণ অর্থ বা সমমূল্যের সরকারী প্রতিজ্ঞাপত্র জমা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট আদালতকে তা জমা দেওয়ার জন্য আসামীকে অনুমতি দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

উদাহরণ দিয়ে বলা যায় একজন রোহিঙ্গা আসামীকে বিশ হাজার টাকার জামিন মঞ্জুর করা হলে প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী একজন আইনজীবী ও একজন স্থানীয় জামিনদার রোহিঙ্গা আসামীকে আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী পরবর্তী সময়ে আদালতে হাজির করাতে পারবেন তা নিশ্চিত না হলে কোন আইনজীবী বা স্থানীয় জামিনদার জামিনদার হতে আগ্রহী না হলে সেই রোহিঙ্গা আসামী জামিনদারের পরিবর্তে নগদ জামানত দেওয়ার প্রস্তাব করতে পারেন এবং আদালত তা গ্রহন করার জন্য অনুমতি দিতে পারেন ৫১৩ ধারার ক্ষমতাবলে।

ফৌজদারী কার্যবিধির ৫১৩ ধারা আদালতকে আসামীর প্রার্থনামতে জামিনদারের পরিবর্তে নগদ জামানত দেওয়ার অনুমতি দেওয়ার ক্ষমতা দিয়েছে, নগদ জামানত দেওয়ার শর্ত আরোপ করার ক্ষমতা দেয় নাই।

৪৫ ডিএলআর(এডি) ৮ পৃষ্টায় প্রকাশিত মহামান্য সুপ্রীমকোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী, বিচারপতি শাহাবউদ্দিন আহমেদ, বিচারপতি এমএইচ রহমান ও বিচারপতি এটিএম আফজলকর্তৃক (তাঁরা সকলে সুপ্রীমকোর্টের প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন) প্রদত্ত রায়ে ঘোষণা করেছেন যে, শর্তযুক্ত জামিন মঞ্জুর করা অবৈধ। ৯ বিএলডি(এডি) ৩ পৃষ্টায় প্রকাশিত মহামান্য সুপ্রীমকোর্টের আপিল বিভাগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ীও জামিনের সাথে শর্ত আরোপ করা অবৈধ। আমার জানামতে মহামান্য সুপ্রীমকোর্ট ও হাইকোর্ট বিভাগের উল্লেখিত সিদ্ধান্তগুলি বাতিল করে নতুন কোন রায় বা সিদ্ধান্ত হয় নাই। বরং উল্লেখিত সিদ্ধান্তগুলি সমর্থন করে আরো অনেকগুলি রায় ও সিদ্ধান্ত প্রকাশিত হয়েছে।

হাইকোর্ট বিভাগের মাননীয় বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মোঃ আমিনুল ইসলাম হাজতী আসামী জামাল আহমদ পিতা সৈয়দুল ইসলাম,উচিপ্রাং রোহিঙ্গা ক্যাম্প কর্তৃক দায়েরকৃত ফৌজদারী আপিল ১৯২৩/২০২৩ নং মামলায় গত ১৬/৩/২০২৩খ্রিঃ তারিখ প্রদত্ত আদেশে অস্ত্র আইনের ১৯এ/১৯(এফ) ধারার স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল মামলা নং ৩৪৩/২০২২ তে ৬টি শর্তে এক বছরের জন্য অন্তবর্তীকালীন জামিন মজ্ঞুর করেন। ৩নং শর্তে রোহিঙ্গা আসামীর পক্ষে জামিননামা সম্পাদনের সময় দুই লক্ষ টাকা বিচারিক আদালতে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন। হাইকোর্ট বিভাগের এই আদেশ সংশ্লিষ্ট অধস্তন আদালত মানতে বাধ্য। কিন্তু এই এক বছরের জন্য প্রদত্ত অন্তবর্তীকালীন আদেশ পরবর্তীকালে বা আপীল শুনানীর সময় আবার বাতিলও হতে পারে। তাই অন্তবর্তীকালীন আদেশ চুড়ান্ত রায়ের মত ঘোষিত রায় বা আইন নয়।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত দায়রা জজ ১ম আদালতে বিচারাধীন এস,টি ১৩৮২/২০২২ নম্বর মামলায় হাইকোর্ট বিভাগ হাজতী আসামী জাহিদ আলম পিতা মোঃ আয়াছকে অধস্তন আদালতের সন্তোষ্টি সাপেক্ষে জামিননামা সম্পাদনের শর্তে জামিনে মুক্তির নির্দেশ দেন।

ভেকেশন জজের দায়িত্ব থাকা দায়রা জজ দুই লক্ষ টাকা জামানত ও দুই লক্ষ টাকার জামিননামা সম্পাদনের শর্তে জামিনে মুক্তির আদেশ দিলে আসামীর পক্ষে জামিননামার টাকার পরিমাণ কমানোর প্রার্থনায় মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগে ফৌজদারী মিচ ৫৪১৯৪/২০২২ নম্বর মামলা দায়ের করলে রাষ্ট্রপক্ষসহ উভয়পক্ষকে শুনানী করে দরখাস্ত মজ্ঞুর করে তর্কিত আদেশ বাতিল করে জামানত ব্যতীত জামিননামার টাকার পরিমাণ যুক্তিসঙ্গতভাবে কমিয়ে নতুন জামিননামা গ্রহন করে হাজতী আসামীকে মুক্তি দেওয়ার আদেশ দেন বিচারপতি মোহাম্মদ সেলিম ও বিচারপতি মোঃ রিয়াজ উদ্দিন খানকর্তৃক গত ১৫/৩/২০২৩খ্রিঃ তারিখ ঘোষিত রায়ে। সর্ব শেষ ফৌজদারী মিচ ১৯৭৬৯/২০২৩ নম্বর মামলায় বিগত ২৯/৫/২০২৩খ্রিঃ তারিখের রায় ও আদেশে হাইকোর্ট বিভাগ জামানতসহ জামিননামা সম্পাদনের অতিরিক্ত দাযরা জজকর্তৃক প্রদত্ত আদেশ অবৈধ বিবেচনায় বাতিল করে দিয়ে জামানত ব্যতীত জামিননামার পরিমাণ যুক্তিসঙ্গতভাবে কমিয়ে নতুন করে জামিননামা সম্পাদন ও গ্রহন করে কারাবন্দি আসামীকে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দেন।

হাইকোর্ট বিভাগের ঘোষিত রায় বা ঘোষিত আইন আপীল বিভাগকর্তৃক স্থগিত বা বাতিল না করা পর্যন্ত সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অধস্তন সকল আদালতের জন্য অবশ্যপালনীয় ।

মাননীয় নবাগত জেলা ও দায়রা জজ মহোদয়ের প্রতি কক্সবাজার জেলাবাসীর পক্ষে বিনীত নিবেদন ও নির্দোষ প্রত্যাশা, অনুমানিক দেড় বছর আগে থেকে চালু করা আসামীদের জামিননামার অতিরিক্ত জামানত দেওয়ার অবৈধ ও অমানবিক নিয়ম অনুসরণ না করে আগে কক্সবাজারে দায়রা জজ হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী ১৫জন প্রখ্যাত বিচারকদের মত উচ্চ আদালতের অবশ্যপালনীয় উল্লেখিত সিদ্ধান্তগুলো মান্য করে জামিননামার সাথে জামানত প্রদানের অসহনীয় বোঝা থেকে বিচারাধীন আসামীদের মুক্তি দিয়ে কৃতজ্ঞভাজন হবেন।

লেখকঃ একজন কলামিষ্ট, সাবেক সভাপতি কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতি, সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটার, বহু বইয়ের প্রণেতা এবং কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের একজন সিনিয়ার আইনজীবী।