পড়াশোনার জন্য ব্যাংক ঋণ— কারা দিচ্ছে, কিভাবে দিচ্ছে

চট্টগ্রাম প্রতিদিন ◑

পড়াশোনায় বরাবরই মেধাবী আবির। তার পরীক্ষার ফলাফল সেই স্কুল থেকেই গর্বিত করে চলেছে তার বাবা-মাকে। কিন্তু যখন তার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় আসলো— তখন বাবার চোখেমুখে নেমে আসে অন্ধকার। পেশায় কেরানি এই বাবা তার মেধাবী সন্তানটির পড়াশোনার খরচ কিভাবে চালাবেন— তা নিয়ে মুহূর্তেই হতাশ হয়ে পড়েন অক্ষমতায়।

দুর্ভাগ্যের এই গল্প কেবল আবিরের নয়, তার মতো হাজারও শিক্ষার্থীর জীবনে এই গল্প খুব চেনা। উচ্চশিক্ষা যাদের জীবনে কেবলই হতাশা ও বিষাদের। এরকম দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা কেউ যদি বিদেশ থেকে একটা ডিগ্রি নিতে চান, তাহলে সেটা হয়ে দাঁড়ায় শুধুই এক দুঃস্বপ্ন।

তবে দরিদ্র পরিবার থেকে আসা শিক্ষার্থীদের এই বাধার কথা মাথায় রেখে এখনকার ব্যাংকগুলো কিছু সমাধান দিচ্ছে। এসব শিক্ষার্থীর পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য ‘শিক্ষা ঋণ’ এখন অনেকটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ব্যাংক থেকে এই ঋণের জন্য শিক্ষার্থীরা আবেদন করতে পারেন।

যেখানে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অপর্যাপ্ত বাজেট, শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি, প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং সর্বোপরি শিক্ষার খারাপ মানে জর্জরিত— সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি সাধারণ প্রবণতা দেখা যায়, কোনো একটি উন্নত দেশের একটি নামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিশ্চিত করা। শিক্ষার এখন যা পরিস্থিতি, তাতে যে কোনো তরুণের মনেই থাকে গোপন একটি স্বপ্ন— পশ্চিমের কোনো দেশ কিংবা চীন, দক্ষিণ কোরিয়া বা জাপানের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার পর বিদেশেই ক্যারিয়ার গড়ে তোলা।

বিত্তবান পরিবারের ছেলেমেয়েরা খুব সহজেই এই পথ বেছেও নিচ্ছে। কিন্তু যাদের স্বপ্ন চাপা পড়ে থাকে আর্থিক চাপের বোঝার নিচে— এই লেখাটি মূলত তাদের জন্য।

বাংলাদেশে এখন অনেক ব্যাংক স্থানীয় ও বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য ‘শিক্ষা ঋণ’ দিয়ে থাকে। বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে শিক্ষার্থীরা মার্কেন্টাইল ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংকসহ আরও কিছু ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারেন। অন্যদিকে সরকারি ব্যাংকের মধ্যে অগ্রণী ও জনতা ব্যাংক শিক্ষার্থীদের ঋণ দিয়ে থাকে।

মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেড বাংলাদেশে পড়াশোনার জন্য সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা এবং বিদেশে পড়াশোনার জন্য সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা ঋণ দিয়ে থাকে। এই ঋণ কোর্সের ধরনের ওপর নির্ভর করে ন্যূনতম এক বছর এবং সর্বোচ্চ ছয় বছর মেয়াদে নেওয়া যায়। দেশে বা বিদেশে যে কোন স্বীকৃত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে এসএসসি/এইচএসসি/ও-লেভেল/এ-লেভেল বা সমতুল্য পরীক্ষায় ১৮ থেকে ২৬ বছর বয়সী যে কোন শিক্ষার্থী ঋণের জন্য আবেদন করতে পারবেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ মিলবে এই লিংকে

ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড শিক্ষার্থীদের জন্য তিনটি ঋণ সুবিধা দিচ্ছে। এগুলো হল সিকিউরিটি ডিপোজিট ছাড়া শিক্ষা ঋণ, সিকিউরিটি ডিপোজিটসহ শিক্ষা ঋণ এবং সিকিউরিটি ডিপোজিটের বিপরীতে ঋণ সুবিধা। এর মধ্যে প্রথম প্রকল্পের আওতায় ১ লক্ষ থেকে ২০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণ নিতে পারেন এবং বাকিরা ১ লক্ষ থেকে ২৫ লক্ষ টাকা বা সিকিউরিটি ডিপোজিটের ৯০ শতাংশ ঋণ দিতে পারেন। ইস্টার্ন ব্যাংকের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট অনুসারে প্রতিযোগিতামূলক সুদের হারসহ ঋণ পরিশোধের সময়সীমা ১২ থেকে ৬০ মাস। এই ধরনের ঋণের প্রসেসিং ফি ঋণের পরিমাণের এক শতাংশ। এ বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ মিলবে এই লিংকে

এনসিসি ব্যাংক বা ন্যাশনাল ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক লিমিটেড ১ লাখ টাকা থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত শিক্ষা ঋণ দিয়ে থাকে। এ বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ মিলবে এই লিংকে

উত্তরা ব্যাংকেরও আছে সর্বোচ্চ ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত শিক্ষা ঋণ প্রকল্প। ২৫ বছর থেকে ৬০ বছর বয়সী ব্যক্তি— যাদের নিজস্ব আয়ের উৎস আছে, তারা ছাড়াও শিক্ষার্থীর পক্ষে অভিভাবকরাও এই ঋণ নিতে পারবেন। বিস্তারিত বিবরণ মিলবে এই লিংকে

ওয়ান ব্যাংকের শিক্ষা ঋণ সংক্রান্ত তথ্য মিলবে এই লিংকে

এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের শিক্ষা ঋণ সংক্রান্ত তথ্য মিলবে এই লিংকে

আইএফআইসি ব্যাংক তাদের ঋণ প্রকল্প ‘পড়ুয়া’র আওতায় শিক্ষার্থীদের জন্য ঋণ দিয়ে থাকে, যা সর্বোচ্চ ৮ লাখ টাকা মাসিক কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে।

ব্র্যাক ব্যাংকও শিক্ষা ঋণ নিয়ে কিছু সেবা চালু করেছে, যা দেশে থাকা বা বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যেতে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের বাবা-মা বা আর্থিক নিশ্চয়তা দিতে পারে এমন ব্যক্তিদের মাধ্যমে নেওয়া যায়। এই ঋণ পেতে পিতামাতার মাসিক আয় কমপক্ষে ২৫ হাজার টাকা হতে হবে। ব্যাংক পিতামাতার মোট মাসিক আয়ের ১৫ গুণ ঋণ দেবে। ঋণ ছোট মাসিক কিস্তিতে পরিশোধ করার সুযোগ রাখা হয়েছে।

নয়টি পাবলিক ব্যাংকের মধ্যে অগ্রণী ব্যাংকেও রয়েছে বিদেশে উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী শিক্ষার্থীদের জন্য ঋণ সুবিধা। এই ব্যাংক ৯ শতাংশ সুদ সহ পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেয়। ওই ঋণ সর্বোচ্চ ৬০ কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে।

প্রাইম ব্যাংকের শিক্ষা ঋণ নামে একটি স্কিম চালু আছে। শিক্ষা ঋণ ছাত্র বা ছাত্রীর অভিভাবককে দেওয়া হয়। অভিভাবকের আয় অনুযায়ী ঋণের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। ১ থেকে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ নেওয়া যায়। পরিশোধের সর্বোচ্চ সময়সীমা ২ বছর। ১৫ শতাংশ হারে সুদ দিতে হয়। বিস্তারিত বিবরণ মিলবে এই লিংকে

ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণ ক্রয়ের ক্ষেত্রে পণ্যসামগ্রীর মূল্যের এক-চতুর্থাংশ ডাউন পেমেন্ট নিয়ে ঋণ দেয়। এ জন্য অবশ্য প্রতি বছর ১২.৫০ শতাংশ এবং সুপারভিশন চার্জ হিসেবে ২ শতাংশ হারে শোধ করতে হয়। এখানে মাসিক কিস্তিতে সর্বোচ্চ ২ বছরের মধ্যে পণ্যের মূল্য পরিশোধ করতে হয়। বিস্তারিত বিবরণ মিলবে এই লিংকে

জনতা ব্যাংক লিমিটেড শিক্ষা ঋণ কর্মসূচির আওতায় চাকরিজীবিদের উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য বিভিন্ন মেয়াদে অল্প সুদে শিক্ষা ঋণ দিয়ে থাকে। ঋণের গ্রাহককে বিভিন্ন সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্বশাসিত সংস্থা, ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কর্মরত হতে হবে এবং কমপক্ষে ২ বছর বর্তমান প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ও স্থায়ী চাকুরে হতে হবে। ঋণ গ্রহীতার মাসিক নিট বেতন ন্যূনতম ২৫ হাজার টাকা হতে হবে। জামানত ছাড়া সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা এবং জামানতসহ সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া হয়ে থাকে। ঋণের মেয়াদ সর্বোচ্চ ৬০ কিস্তি বা ৫ বছর। বিস্তারিত বিবরণ মিলবে এই লিংকে

বিদেশি ব্যাংকের মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক এবং এইচএসবিসি ব্যাংকেও শিক্ষার্থীদের জন্য ঋণ সুবিধা আছে।

এইচএসবিসি ব্যাংক থেকে শিক্ষা ঋণ নিতে কোনো ব্যক্তিগত গ্যারান্টি বা নগদ জামানত দিতে হয় না। তবে ঋণ নিতে হলে অবশ্যই পরিবারের কোনো সদস্যকে আয় করতে হবে এবং তার মাসিক আয় ১৮ হাজার থেকে ২২ হাজার হতে হবে। এইচএসবিসি ৫০ হাজার টাকা থেকে ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা অথবা ঋণ গ্রহণকারীর মাসিক আয়ের ৪ গুণ পরিমাণ ঢাকা ঋণ দিয়ে থাকে। ঋণের সুদের হার ১৮%। তুলনামূলক কম সুদে এই ঋণ পরিশোধ করতে হয় ১২, ২৪, ৩৬, ৪৮ ও ৬০ মাসের মধ্যে। বিস্তারিত বিবরণ মিলবে এই লিংকে