বানর বুড়া হলেও গাছ বাইতে পারে

আমাদের গ্রামে-গঞ্জে একটা কথা প্রায়ই শোনা যায় বানর বুড়া হইলেও গাছ বাইতে পারে। অর্থাৎ একটা বানর ছোট থাকতেই যেমন গাছ বাইতে পারে তেমনি তার বয়স হলেও একই রকম গাছ বাইতে পারে। বয়সের ভার তার চলাফেরার ক্ষেত্রে কোন বাঁধা হয় না।
বয়স তার তারুণ্য-যৌবন কিংবা বার্ধক্যকে প্রভাবিত করতে পারে না।
আমাদের সমাজেও এরকম অনেক মানুষ আছে যারা বয়স হয়েছে, বৃদ্ধ হয়েছে বটে বটে কিন্তু বয়স তাদের জীবনকে প্রভাবিত করতে পারেনি। হয়তো বয়সের ছাপ শরীরে গঠনে চুল-দাঁড়ি সাদা হয়ে গিয়েছে কিন্তু তাদের মনে প্রভাব পড়েনি, তাদের অভিজ্ঞতায় প্রভাব পড়েনি। কথায় বলে বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষের অভিজ্ঞতা বাড়ে ঠিক তেমনই। যখন সময় ছিল প্রবীণরা (তখনকার তরুণরা) তাদের সময়, শ্রম ও আন্তরিকতা দিয়ে পৃথিবীকে বর্তমান পর্যায়ে রেখেছে।
আমাদের প্রায়ই পরিবারে এরকম বয়স্ক প্রবীণ মুরুব্বি আছে যাদের অভিজ্ঞতা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি, তাদের ধ্যান, জ্ঞান, পরিশ্রম, অধ্যাবসায় আমাদের বয়সের কয়েক গুণ।
তারা বেশিরভাগই স্বাধীনতা পূর্বকালীন জন্ম।পরিবারের কিংবা সমাজের কোন পরামর্শ বা সিদ্ধান্ত নেবার সময় আগে প্রবীনদেরই সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করতে হতো তখন। আর তাদের সিদ্ধান্তকেই চূড়ান্ত হিসেবে মাথা পেতে মেনে নিতো সবাই। এটাই ছিল পারিবারিক রীতি, এটাই ছিল নিয়ম। প্রবীণ বৃদ্ধদের পরামর্শ আর সিদ্ধান্তের বাইরে পারিবারে কিংবা সমাজে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হতো না কিংবা নিতে সাহসও করতো না কেউ। তারা তাদের সর্বস্থ দিয়ে পরিবারকে টিকিয়ে রেখেছেন। তখনকার আমল আর বর্তমান আধুনিক আমলের বিস্তর পার্থক্য। বলতে গেলে এই শতাব্দী সম্পূর্ণ বদলে গেলে প্রযুক্তির ছোঁয়ায়। বর্তমান ডিজিটাল প্রযুক্তির কল্যাণে হয়তো আমরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অতি সহজেই জ্ঞান, ধ্যান ধারণা লাভ করতে পারছি। এখন পরিবার কিংবা সামাজের কোন বুদ্ধি, ধ্যান জ্ঞানের জন্য কোন প্রবীণ কিংবা বৃদ্ধদের প্রয়োজন পড়ে না। বয়স এখন জানার জন্য কোন বাধা নয়, হাতের ছোঁয়ায় সব বিষয়ে জানা যায় বহির্বিশ্বকে। কোন পরামর্শ বা সিদ্ধান্ত নিতে এখন প্রবীণ বা বৃদ্ধদের খোঁজ কেউ সহজে করে না। বাড়ির প্রবীণ বৃদ্ধ মুরুব্বিকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয় না (কিছু কিছু ক্ষেত্রে)। এটা বিশেষ করে দেখা যায় পারিবারিক কোন বিয়ে শাদি কিংবা অন্যকোন অনুষ্ঠানে। সোজা একটা বলেই তাদেরকে চুপ করানো হয়, তোমরা সেকেলে। তোমাদের যুগ আর বর্তমানে যুগ এক নয়, এখন আগের প্রাচীন কালের বুদ্ধি চলে না, বিশ্ব বদলে গেছে। আগের যুগের বিয়ে নয় এটি। এটা বর্তমানের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। ব্যস হয়ে গেলো! বাড়ির চুল দাঁড়ি পেকে বৃদ্ধ হওয়া প্রবীণ মুরুব্বির আর বলার মতো বাক্য থাকে না।
নিরবে মেনে নেয় যুগ পাল্টেছে, তাদেরটাই ঠিক। যুগ পাল্টেছে, পৃথিবী বদলে যাচ্ছে দিনদিন। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় নিত্যনতুন বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা হচ্ছে। তাই বলে প্রবীণ মুরুব্বিদের কখনো অবহেলা করা যাবে না। মনে রাখতে হবে প্রবীণ মুরুব্বিরা বাড়ির খুঁটি, বাড়ির সম্পদ, সমাজের অলংকার। চারপাশে অনেক প্রবীণ ব্যক্তিকে দেখেছি এবং দেখছি, প্রতিনিয়ত যারা পরিবার আর সমাজে নিগৃহীত হচ্ছেন। অবহেলা আর অনাদরে জীবনের বাকি সময়গুলো পার করছেন।

প্রবীণরা আসলেই ভালো অবস্থানে নেই। আমাদের দেশের ৮০ শতাংশ প্রবীণ-প্রবীণাই কর্মহীন, পরমুখাপেক্ষী; পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন ও অবহেলিত।
প্রবীণদের পরিবার ও সমাজে বোঝা মনে করা হয়। যেসব পরিবারে আয়-রোজগার কম, অভাব নিত্যসঙ্গী, মানবিক মূল্যবোধ কম, সেসব পরিবারে প্রবীণদের অবস্থা আরও করুণ। যেখানে তথাকথিত শিক্ষিত, বিত্তশালী পরিবারেই প্রবীণ-প্রবীণারা ভালো অবস্থানে নেই, সেখানে নিম্নবিত্ত বা নিুমধ্যবিত্ত পরিবারের কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
অধিকাংশ পরিবারে ছেলে বা ছেলের বউয়ের দয়া এবং করুণায় তাদের বেঁচে থাকতে হয়। অনেক পরিবারে সন্তানরা বৃদ্ধ বাবা-মাকে অপাঙ্ক্তেয় ভেবে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে। পরিবারে ও সমাজে তাদের কথা, পরামর্শ কিংবা মতামতের কোনো গুরুত্ব দেয়া হয় না। অথচ প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে এক সময় প্রতিটি মানুষকে বার্ধক্যের স্বাদ গ্রহণ করতে হবে, এ কথা কেউ মনে রাখে না। আজ যারা প্রবীণদের অবহেলা-অনাদর করছেন তারাও এক সময় প্রবীণ হয়ে যাবেন। প্রকৃতির এ অমোঘ বাস্তবতাকে কেউ স্বীকার করতে চায় না।
অথচ এ বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে আমরা যদি বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান করি, ভালোবাসি তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তা দেখে শিক্ষা গ্রহণ করবে; পরিবার ও সমাজে প্রবীণরা স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস ও চলাফেরা করতে পারবেন।

প্রবীণরা সমাজের বোঝা নয়, তারা অলংকার। হয়তো শারীরিকভাবে তারা কাজে অংশ নিতে পারবেন না। কিন্তু তাদের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য অমূল্য সম্পদ। প্রবীণদের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানকে কাজে লাগাতে হবে। প্রবীণদের যথাযোগ্য সম্মান, মর্যাদা ও সেবাপ্রদানের জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। পরিবারে সন্তানদের দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এ কথা সবাইকে মনে রাখতে হবে, প্রবীণরা পরিবার বা সমাজে বোঝা নন বরং তারা মূল্যবান সম্পদ।

মোঃ মাসুম হোসেন