মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা অস্ত্র পাচ্ছে কোথায়

উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের রহমতবিল স্কুলের সামনে মঙ্গলবার দুপুরে বিজিবির তত্ত্বাবধানে জড়ো করা হয় বিজিপি সদস্যদের। প্রবা ফটো

সামরিক সক্ষমতা বিবেচনায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অবস্থান বিশ্বে ৩৫তম, যা বাংলাদেশ থেকে দুই ধাপ ওপরে। এ ধরনের একটি শক্তিশালী বাহিনীকে রীতিমতো নাস্তানাবুদ করছে দেশটির বিদ্রোহী ও প্রতিরোধকারী গোষ্ঠীগুলো। দেশটির রাজ্যে রাজ্যে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের হাতে একের পর ঘাঁটি ও শহরের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে দেশটির সেনাবাহিনী। প্রশ্ন হতে পারে, সামরিক সক্ষমতাসম্পন্ন মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে কী করে ঘায়েল করছে বিদ্রোহীরা। তারা এত অস্ত্রও কোথায়বা পাচ্ছে? দেশটির গেরিলা গোষ্ঠীগুলোর সাফল্যের মূল জায়গা নিজেদের অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা।

মিয়ানমার সেনাবাহিনী ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি নির্বাচিত সরকার প্রধান অং সান সু চিকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করে। ফলে দেশটিতে শুরু হয় শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ। কিন্তু জান্তা সরকার তা কঠোর হাতে দমন করে। বিশেষ করে মার্চ মাস থেকে বিক্ষোভকারীদের নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করতে শুরু করে জান্তা সরকার।

প্রতিক্রিয়ায় বিক্ষোভকারীরা গা ঢাকা দেয়। কিন্তু এপ্রিল নাগাদ তারা গড়ে তোলে জাতীয় ঐক্য সরকার (নাগ)। পরের মাসে নাগ নিজেদের সামরিক শাখা গণপ্রতিরোধ বাহিনী (পিডিএফ) তৈরি করে। পিডিএফ দেশটির পুরোনো জাতিগত বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করলে বড় একটা অংশ তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। এ ছাড়া মিয়ানমারের শহরে গ্রামে স্থানীয়দের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে পিডিএফের শাখা।

সাগাইং অঞ্চলের কো কিয়াও হিতিন নিজের এলাকায় পিডিএফ গঠন করেন। হিতিন একজন আইটি ইঞ্জিনিয়ার। বন্ধুদের সঙ্গে একত্র হয়ে ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) তৈরির পরিকল্পনা করেন হিতিন। তার মতো এমন তৎপরতা মিয়ানমারের গহীন অরণ্যে ছড়িয়ে পড়েছে।

বিস্ফোরক ও মাইন

সাগাইং অঞ্চলের ইয়েনমেবিন শহরের পিডিএফের আরেক সদস্য কো ফনিক্স ইরাবতিকে বলেন, হাতের কাছে যেসব উপাদান পাওয়া যায় তা দিয়েই আমরা আইইডি এবং আরও কয়েক ধরনের অস্ত্র বানাতে শুরু করি। এসব কাজে প্রধানত লোহার পাত ও গানপাউডার ব্যবহার করা হয়। ইউটিউব দেখেই আমরা প্রাথমিক জ্ঞান সংগ্রহ করি। তাছাড়া কিছু পুরোনা বিদ্রোহী গোষ্ঠীও আমাদের এসব কাজে সহায়তা করে।

সাগাইংয়ের পিডিএফের এ গোষ্ঠীটি মাইনও তৈরি করে। জান্তার বাহিনীকে ঘায়েল করার জন্য মাইন বেশ কার্যকর বলে জানান ফনিক্স।

মর্টার ও রকেট

সাগাইং পিডিএফ মর্টার ও রকেটের মতো আধুনিক অস্ত্রও তৈরি করছে। নিজেদের তৈরি স্বল্পপাল্লার রকেট সিস্টেম দিয়ে তারা জান্তাকে অস্থির করে তুলেছে বলে জানান হিতিন। এ গেরিলা নেতা বলেন, আমাদের রকেট সিস্টেমের মাধ্যমে প্রায় নয় মাইল দূরে গোলা নিক্ষেপ করা যায়। ২০২২ সালের মে মাসে আমরা সর্বপ্রথম এর ব্যবহার করি। এতে জান্তার প্রায় ১০ জন সেনা নিহত হয়।

সাব-মেশিন গান

২০২১ সালের শেষভাগে সেনাবাহিনী, পুলিশসহ আরও কয়েকটি বাহিনীর সদস্যরা পিডিএফে যোগ দিতে শুরু করেন। ইতোমধ্যে অনেকে অস্ত্র বিশেষজ্ঞও পিডিএফে যোগ দিয়েছেন। এসব বিশেষজ্ঞকে নিয়ে গড়ে তোলা হয় পিপলস সোলজারস প্রডাকশন টিম। তারা এসআর-১ সাব মেশিন গান তৈরি করছেন। এই মেশিন গানে ৯ বাই ১০ এমএম বুলেট ব্যবহার করা যায়।

পিপলস সোলজারস প্রোডাকশন টিমের বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সেনা কর্মকর্তা নিই থুতা বলেন, এসআর-১ একটি মিলিটারি গ্রেডের অস্ত্র। আমাদের হাতে যদি ৩ থেকে ৪ লাখ এ ধরনের মেশিন গান থাকে, তাহলে এটা যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেবে। ২০২২ সালের শুরুর দিকে তিনি এ কথা বলেছিলেন। এতদিনে তারা কী পরিমাণ সাব-মেশিন গান তৈরি করেছে তা জানা যায়নি।

ড্রোন তৈরি

জান্তা বাহিনীর ওপর ড্রোন হামলা চালিয়ে পিডিএফ বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে। ভিডিও করার ড্রোন সংস্কারের মাধ্যমে তা থেকে বিস্ফোরক নিক্ষেপ করছে তারা। ক্যামেরা ড্রোনকে সামরিক ড্রোনে পরিণত করতে কয়েক মাস লেগেছে বলে জানায় পিডিএফের সামরিক শাখা।

জানা গেছে, ড্রোন তৈরি বেশ ব্যয়বহুল। প্রতিটি ড্রোন তৈরি করতে ১ হাজার ৬০০ থেকে ১৬ হাজার ডলার পর্যন্ত দরকার। এজন্য বিদেশি সহায়তা দরকার প্রতিরোধ যোদ্ধাদের।

গত অক্টোবর থেকে রাখাইন প্রদেশে জান্তার বিরুদ্ধে ‘অপারেশন ১০২৭’ নামে অভিযান শুরু করে থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স নামে তিন বিদ্রোহী গোষ্ঠীর একটি জোট। আরাকান আর্মি, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি এবং তায়াং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি জোটটির তিন সদস্য। আরাকান আর্মি জোটের সবচেয়ে শক্তিশালী বিদ্রোহী গোষ্ঠী।

সম্প্রতি বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী মংডুতে জান্তার বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের তীব্র সংঘাত চলছে। সংঘাতে মঙ্গলবার পর্যন্ত মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশসহ (বিজিপি) ও সেনাবাহিনীসহ আরও কয়েকটি সরকারি বাহিনীর ২৬৪ সদস্য আশ্রয় নিয়েছে। একই সময়ে মিয়ানমারের অন্তত আট নাগরিকও বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। মিয়ানমার থেকে আসা মর্টার শেলে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত অন্তত দুজন নিহত হয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের ২৮৩ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে।

সূত্র : ইরাবতি