রোহিঙ্গা ডাকাতের রাজ্য ‘এডরা পাহাড়’

বাংলা ট্রিবিউন ◑

খুন, ধর্ষণ, ইয়াবা কারবার, মানবপাচার, অপহরণ—এমন কোনও অপরাধ নেই যা ‘এডরা পাহাড়ে’ হচ্ছে না। কক্সবাজারের টেকনাফের জাদিমোরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের প্রধান সড়ক থেকে দুই কিলোমিটার ভেতরে এই পাহাড়ের অবস্থান। ক্যাম্পের ত্রাস হিসেবে পরিচিত কুখ্যাত রোহিঙ্গা ডাকাত জকির আহমদ ওরফে জাকির সেখানে আশ্রয়স্থল বানিয়ে গড়ে তুলেছে অপরাধ জগত। অপরাধের এত শক্ত নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে সে, যেখানে সাধারণ লোকজনের চলাফেরা তো দূরে থাকুক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও প্রবেশ করতে বেগ পায়। স্থানীয় লোকজন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

সোমবার (২ মার্চ) ভোর থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত টেকনাফের জাদিমোরা ও শালবনের মাঝামাঝি এডরা পাহাড়ে র‍্যাবের সঙ্গে গোলাগুলিতে সাত ডাকাত নিহত হয়েছে। তারা সবাই জকির ডাকাত দলের সদস্য ছিল। এরমধ্যে পরিচয় মিলেছে টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের জাদিমোরা ও শালবন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা মোহাম্মদ ফারুক (৩০), মোহাম্মদ আলী (২৫), নুর হোসেন ওরফে নুর আলি ও ইমরানের (৩২)। বাকিদের পরিচয় পাওয়া যায়নি।

কক্সবাজার র‍্যাব-১৫ অধিনায়ক উইং কমান্ডার আজিম আহমেদ বলেন, ‘এডরা নামের গভীর পাহাড়ে কুখ্যাত রোহিঙ্গা ডাকাত জকির গ্রুপের সদস্যরা অবস্থান করছিল। এ খবর পেয়ে আমার নেতৃত্বে র‍্যাবের একটি বিশেষ টিম চিহ্নিত পাহাড়ের বিভিন্ন পথে একে একে চারটি পাহাড় ডিঙ্গিয়ে ডাকাতদের আস্তানায় পৌঁছায়। সেখানে সশস্ত্র ডাকাতরা র‍্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে। এতে উভয় পক্ষের মধ্যে থেমে থেমে বন্দুকযুদ্ধ চলতে থাকে। এ সময় রোহিঙ্গা ডাকাত গ্রুপের সাত সদস্যের গুলিবিদ্ধ মরদেহ পাওয়া যায়।

র‍্যাব সদস্যরা তল্লাশি চালিয়ে তিনটি বিদেশি পিস্তল, ১২ রাউন্ড গুলি, সাতটি ওয়ান শুটারগান ও ১৩ রাউন্ড কার্তুজের গুলি উদ্ধার করে। নিহতদের মধ্যে চার জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তাদের ক্যাম্পের লোকজন ডাকাত হিসেবে শনাক্ত করেছে। এ ঘটনায় তিনটি মামলা রুজুর প্রক্রিয়া চলছে।’

তিনি বলেন, ঘটনার সময় রোহিঙ্গা ডাকাত জকিরও ছিল। তবে সে পালিয়ে যায়। সে এই পাহাড়েই কোথাও লুকিয়ে থাকতে পারে।

পাহাড়ের ওপরে ঝুপড়িতে ডাকাতের আশ্রয়স্থল
টেকনাফের জাদিমোরা ও শালবনের মাঝামাঝি পাহাড়ের আশপাশে রোহিঙ্গাদের যেসব ঝুপড়ি রয়েছে সেগুলো নির্মাণ করেছিল অ্যাডভেন্টিস্ট ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রিলিফ এজেন্সি (এডরা) নামে একটি এনজিও। এ কারণেই সেই জায়গাটি রোহিঙ্গাদের কাছে এডরা নামে পরিচিত। তবে ক্যাম্পের ভেতর রোহিঙ্গাদের বিশাল সমাবেশের পেছনে সম্পৃক্ততা পাওয়ায় কানাডাভিত্তিক এনজিও এডরার কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় সরকার।

টেকনাফ শালবন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এক মাঝি (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, ‘এডরা পাহাড়ে ছড়ার পাশে যে ঝুপড়ি ঘর রয়েছে সেখানে জকির ডাকাত বাহিনীর সদস্যরা আশ্রয় নিতো। তারা কয়েকদিন পর পর সেখানে এসে থাকতো। তবে সেখানে সাধারণ কাউকে যেতে দিতো না। মাঝে মধ্যে আশপাশের লোকজন সেই ঘর থেকে চিৎকারের শব্দ পেতো। কিন্তু ভয়ে কেউ কিছু বলতে সাহস পায়নি। কেননা, তারা ধর্ষণ, খুন ও মুক্তিপণ আদায় করে আসছিল। কিন্তু ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস করতো না। এই ক্যাম্পের বেশিরভাগ মানুষ ডাকাতদের বিরুদ্ধে অভিযানের ঘটনায় খুশি হলেও ভয়ে বলছে না।’

রোহিঙ্গা আবদুর করিম বলেন, ‘এই ক্যাম্প সংলগ্ন পাহাড়ে জাকির ডাকাতের শক্ত অপরাধ নেটওয়ার্ক রয়েছে। পুরো ক্যাম্পের মানুষ তার কাছে জিম্মি হয়ে আছে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি একটু শান্ত হতে পারে। আবার জকির অধরা থাকায় অনেকে ভয়ে রয়েছে। এখানকার পরিবেশে শান্ত করতে হলে তাকে গ্রেফতারের বিকল্প নেই।’

স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, টেকনাফের নয়াপাড়ার সি ব্লকের আমিনের ছেলে জকির (২৮)। জকিরের নেতৃত্বে ২০-২৫ জনের একটি গ্রুপ রয়েছে। তাদের হাতে দেশি অস্ত্র ছাড়াও অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে। কোনও কোনও জায়গায় জাকির বাহিনী ‘সালমান শাহ বাহিনী’ নামেও পরিচিত।

যেভাবে উত্থান জকিরের

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, একসময় রোহিঙ্গা ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণ করত নূরে আলম ডাকাত। তার গ্রুপ এক আনসার সদস্যকে হত্যা করে তার অস্ত্র লুট করেছিল। ২০১৮ সালে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয় সে। এরপর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ নেয় সলিম বাহিনী। নূরে আলম ও সলিম দুজনের সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক ছিল জকিরের। কিন্তু ইয়াবার মুনাফার টাকার ভাগাভাগি নিয়ে সলিমকে হত্যা করে জাকির বাহিনী। এর মধ্য দিয়ে ক্যাম্পে জাকির প্রায় একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।

আয়ের উৎস ইয়াবা, মানবপাচার ও চাঁদাবাজি
জাকির বাহিনীর অর্থের জোগানের একটি বড় উৎস ইয়াবা ও মানবপাচার। বাংলাদেশ-মিয়ানমারের যেসব সিন্ডিকেট ইয়াবা ও মানবপাচার করছে, তাদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোয়ারা নেয় তারা। এমনকি সাগরপথে মানবপাচারের আগে ওইসব পাহাড় পাচারের শিকার ব্যক্তিদের আশ্রয়স্থল হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। অনেক সময় জাকির বাহিনীর সদস্যরা ইয়াবা ও মানবপাচারে সরাসরি সম্পৃক্ত হয়। ইয়াবা ছাড়াও ক্যাম্পে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় তারা নিয়মিত মহড়া দেয়। রোহিঙ্গা নারীদের অপহরণেও জড়িত তারা। রোহিঙ্গাদের অন্যখানে পাচার করেও অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে এই বাহিনী।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন রোহিঙ্গা জানান, নয়াপাড়া ক্যাম্পের পেছনের পাহাড়ে রোহিঙ্গা ডাকাতদের আস্তানা গড়ে উঠেছে। দিনে পাহাড় আর রাতে ক্যাম্পে চষে বেড়ায় তারা। খুন, ধর্ষণ, ইয়াবা কারবার, মানবপাচার, অপহরণ- এমন কোনও অপরাধ নেই যা তারা করছে না।

এদিকে গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর নয়াপাড়া শরণার্থী শিবিরের পাশে জাকির বাহিনীর আস্তানায় অভিযানে গেলে র‍্যাব সদস্যদের ওপর গুলি চালায় তারা। এতে কক্সবাজার র‍্যাব-১৫ সিপিসি-২ হোয়াইক্যং ক্যাম্পের সদস্য সৈনিক ইমরান ও করপোরাল শাহাব উদ্দিন গুলিবিদ্ধ হন।

টেকনাফ সিপিসি-১ ক্যাম্পের ইনচার্জ মির্জা শাহেদ মাহাতাব বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখে রোহিঙ্গা নাগরিক জাকির টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের টপমোস্ট ক্রিমিনাল। দীর্ঘদিন ধরে তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। কিন্তু এখনও অধরাই রয়ে গেছে সে। শক্তিশালী নেটওয়ার্ক থাকায় র‍্যাব-পুলিশ পৌঁছানোর আগেই সে পালিয়ে যাচ্ছে। তাকে দ্রুত গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।’

টেকনাফ মডেল থানার অফিসার ইনর্চাজ (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ বলেন, ‘র‍্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত সাত রোহিঙ্গা ডাকাতের মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য কক্সবাজার মর্গে পাঠানো হয়েছে। ডাকাতদের আস্তানায় পুলিশের বড় অভিযান চলবে।’