কক্সবাজার জেলার নতুন পুলিশ প্রশাসন, পর্যটন, মেগাপ্রকল্প ও রোহিঙ্গা ইস্যুসহ সার্বিক বিষয়ে আইজিপি, র‌্যাব ডিজি ও এসবি প্রধানের সঙ্গে মাঠ কর্মকর্তাদের টানা দু'দিনের বৈঠক

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বাড়তি নজরদারির তাগিদ

শাহাদাত হোসেন পরশ, সমকাল •

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বাড়তি নজরদারি দিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাঠ প্রশাসনকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। রোহিঙ্গারা যাতে মাদক কারবার, নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি আর অপহরণের মতো অপরাধে জড়াতে না পারে সে ব্যাপারে নজর রাখারও পরামর্শ দেওয়া হয়।

ভৌগোলিক, পর্যটন ও অর্থনৈতিকসহ নানা কারণে কক্সবাজার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। সেখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো রাখতে স্থানীয় মাঠ প্রশাসনের মধ্যে আরও সমন্বয় বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা নিয়েও আলোকপাত করা হয়। গত রবি ও সোমবার টানা দু’দিন কক্সবাজারের প্রশাসনের সব মাঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তার রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়।

এতে পুলিশপ্রধান ড. বেনজীর আহমেদ, র‌্যাব মহাপরিচালক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, এসবির প্রধান মনিরুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠকে উপস্থিত একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পুলিশের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে রোহিঙ্গা ইস্যু ছাড়াও সার্বিক বিষয়ে মাঠ কর্মকর্তাদের দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়। জেলা পুলিশের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্য যেসব ইউনিট ও গোয়েন্দা শাখা রয়েছে তাদের মধ্যে সমন্বয় বাড়ানোর বিষয়টি সামনে আসে। পর্যটন এলাকা হিসেবে কক্সবাজারে ট্যুরিস্ট পুলিশ ছাড়াও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), র‌্যাব, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) কাজ করছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তার জন্য এপিবিএনের আলাদা তিনটি ব্যাটালিয়ন সেখানে রয়েছে।
জানা যায়, কক্সবাজারে কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে একাধিক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। এসব প্রকল্পে বিদেশি নাগরিকরা কাজ করছেন। এছাড়া পৃথিবীর দীর্ঘ সৈকত দেখতে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা সারা বছর সেখানে যান। দেশি-বিদেশি নাগরিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

গত বছর কক্সবাজারে মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদের মৃত্যুর পর একযোগে জেলার পুলিশ সদস্য রদবদল করা হয়। নজিরবিহীন ওই রদবদলের পর সম্পূর্ণ নতুন প্রশাসন এবং জনবল দিয়ে চলছে জেলা পুলিশের কার্যক্রম। নতুন পরিস্থিতিতে সেখানে পুলিশ সদস্যরা কীভাবে কাজ করছেন, তাদের সমস্যা ও সফলতার বিষয়গুলো নিয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়। জেলার অপরাধ ও মামলার সার্বিক চিত্র সম্পর্কে পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের অবহিত করা হয়। তদন্তাধীন মামলার সংখ্যা আগের তুলনায় কমেছে বলে জানানো হয়। বৈঠকে মাঠ কর্মকর্তারা

তাদের কিছু সমস্যার কথাও তুলে ধরেন। তার মধ্যে রয়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তায় এপিবিএনের যারা নিয়োজিত তাদের অনেকের আবাসন ব্যবস্থা কাঙ্ক্ষিত মানের নয়। নিজস্ব জায়গায় এপিবিএনের কার্যালয় ও ফোর্সের থাকার ব্যবস্থা এখনও করা যায়নি। দ্রুত জমি অধিগ্রহণ করে এ সমস্যা সমাধানের পরামর্শ দেওয়া হয়।

বৈঠকে পুলিশ মহাপরিদর্শক মাঠ কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরের পরিবেশ নিরাপদ ও সুশৃঙ্খল রাখতে হবে। বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে স্থানীয়দের সঙ্গে পুলিশের যোগাযোগ বাড়ানোর কথা বলেন তিনি। কেউ বিশৃঙ্খলা ঘটানোর পরিকল্পনা করলে যাতে আগাম তথ্য পাওয়া যায় এ ব্যাপারে গোয়েন্দা নেটওয়ার্কও বাড়াতে হবে। এছাড়া পুলিশের স্থায়ী কোনো অস্ত্রাগারও সেখানে নেই।

এদিকে রোহিঙ্গারা যাতে কোনো কৌশলে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে সাধারণ জনসাধারণের সঙ্গে মিশে যেতে না পারে সে ব্যাপারেও বাড়তি নজর দিতে বলা হয়। মাঠ কর্মকর্তাদের সততা, দক্ষতা এবং পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করারও পরামর্শ আসে বৈঠকে। দায়িত্ব পালনকালে যেন কোনো ভুল বোঝাবুঝি না হয় এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলা হয়। সরকার ও রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়োজিত দায়িত্ব পরস্পরের সঙ্গে সমন্বয় করে পালন করতে হবে। এছাড়া অপরাধ দমনে অপারেশনে আরও গতি বাড়ানোর নির্দেশ দেন পুলিশপ্রধান।

মাঠ প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা সমকালকে জানান, এপিবিএনের সফিউল্লাহ কাটা ক্যাম্প ও তাজনিমার খোলার ক্যাম্পের অবস্থা সবচেয়ে নাজুক।

অনেক দিন ধরেই অভিযোগ আছে, রোহিঙ্গাদের মধ্যে কেউ কেউ ইয়াবা কারবারে জড়িয়ে পড়েছে। মাঝে মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তাদের কেউ কেউ ধরাও পড়ছে। এছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। এরই মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ একাধিক ডাকাতও নিহত হয়েছে। তার মধ্যে জকি ও হাশেম অন্যতম।
কক্সবাজারের মাঠ প্রশাসনে কাজ করছেন এমন একজন কর্মকর্তা সমকালকে জানান, ইয়াবা কারবার থেকে রোহিঙ্গাদের বিরত রাখাই তাদের জন্য এখন চ্যালেঞ্জ। স্থল ও জলপথ ব্যবহার করে নানা কৌশলে ইয়াবা কারবার চালাচ্ছে রোহিঙ্গাদের একটি গ্রুপ। অন্যদিকে ক্যাম্পে যারা ডাকাতি, ছিনতাই ও অপহরণের মতো ঘটনায় জড়িত এমন একটি তালিকা তাদের কাছে রয়েছে। তাদের সংখ্যা ১২-১৫ জন। তবে ওই কর্মকর্তার দাবি, আগের তুলনায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ডাকাতি ও অপহরণের ঘটনা কমেছে।

জানা যায়, পুলিশ, র‌্যাব এবং এসবিপ্রধান ছাড়াও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অতিরিক্ত আইজিপি, অতিরিক্ত আইজিপি (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স), ডিআইজি (অপারেশন্স), ডিআইজি (ফাইন্যান্স), ডিআইজি (এপিবিএন), চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি, ট্যুরিস্ট পুলিশের ডিআইজি। এছাড়া কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের এএসপি থেকে তদূর্ধ্ব সব পুলিশ সদস্য বৈঠকে অংশ নেন। পরে পুলিশপ্রধানের সঙ্গে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসকসহ অন্যান্য ইউনিটের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন।