রোহিঙ্গা শিবির জুড়ে মিয়ানমারের মোবাইল নেটওয়ার্ক: নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা

কাজী সোহাগ, এম জমিন ◑

মিয়ানমারের শক্তিশালী মোবাইল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করছেন কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দারা।

রোহিঙ্গা শিবির থেকে মিয়ানমারের সীমান্ত ১০ কিলোমিটার থেকে ৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। সম্প্রতি মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকায় তাদের মোবাইল নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করেছে। এতে রোহিঙ্গারা অনায়াসে মিয়ানমারের মোবাইল সিম ব্যবহার করতে পারছেন। আর কক্সবাজারে বসেই তারা ভয়েস ও ইন্টারনেট সেবা ব্যবহার করে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন।

পাশাপাশি বাংলাদেশের মোবাইল অপারেটরদের সিমও ব্যবহার করছেন তারা। সংশ্লিষ্টরা জানান, আশ্রয় শিবিরগুলোতে থাকা প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা ৮ লাখ মোবাইল সিম ব্যবহার করছেন। এর মধ্যে অর্ধেক সিম রয়েছে মিয়ানমারের।

বাকি অর্ধেক ব্যবহার করা হচ্ছে বাংলাদেশের মোবাইল অপারেটরদের। তবে সব সিম অবৈধ বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান জহুরুল হক। একই দাবি করেছে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশন। রোহিঙ্গারা কি প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের অপারেটরদের সিম ব্যবহার করছে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা।

তারা জানান, দেশের বৈধ নাগরিকদের যেখানে বায়োমেট্রিক ছাড়া সিম ব্যবহার করা যায় না, সেখানে রোহিঙ্গারা অনায়াসেই আমাদের সিম ব্যবহার করছে। এটি আইন বহির্ভূত একটি কাজ। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসিও বিষয়টিকে সম্পূর্ণ আইন বহির্ভূত বলে মন্তব্য করেছে।

এ প্রসঙ্গে বিটিআরসি চেয়ারম্যান জহুরুল হক বলেন, রোহিঙ্গা শিবিরে অবৈধভাবে সিম ব্যবহার করা হচ্ছে। তারা মিয়ানমারের নেটওয়ার্কও ব্যবহার করছেন। এর কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, সীমান্তে মিয়ানমারের যেসব মোবাইল নেটওয়ার্ক রয়েছে সেগুলো অনেক শক্তিশালী। কিন্তু আমাদের দেশের অপারেটরদের নেটওয়ার্ক আবার মিয়ানমার সীমান্ত পর্যন্ত কভার করে না। কারণ নেটওয়ার্ক অনেক দুর্বল।

এ বিষয়ে বিটিআরসি কি ভূমিকা পালন করছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, রোহিঙ্গা একটি আন্তর্জাতিক ও জাতীয় ইস্যু। তাদের বিষয়ে অনেক সিদ্ধান্ত সরকার নিয়ে থাকে। আমরা রোহিঙ্গা শিবিরে থ্রি-জি ও ফোর-জি নেটওয়ার্ক চালুর নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবে এটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। কারণ রোহিঙ্গারা আমাদের দেশের অপারেটরদের সিম কোন প্রক্রিয়ায় নিতে পারবে তা নিয়ে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। কিন্তু রোহিঙ্গা শিবিরে এ পর্যন্ত প্রায় ৮ লাখ সিম কার্যকর রয়েছে এ প্রশ্নে তিনি বলেন, এ সবই অবৈধ।

তবে বিটিআরসি চেয়ারম্যানের এ মন্তব্যর বিরোধিতা করেছে মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন এসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটর্স অব বাংলাদেশ (এমটব)। তারা জানিয়েছে, বিটিআরসির নির্দেশনা অনুযায়ী কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও তৎসংলগ্ন এলাকায় থ্রি-জি ও ফোর-জি সেবা পুনরায় চালু করা হয়েছে। এ নিয়ে অপারেটরদের আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি পাঠিয়েছে বিটিআরসি।

বিটিআরসির সিনিয়র সহকারী সচিব আব্দুল্লাহ আল আমীন স্বাক্ষরিত ওই চিঠি পাঠানো হয় ২৮শে আগস্ট। বিটিআরসির সমালোচনা করে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশন বলেছে- এক বছর বন্ধ থাকার পর গত শুক্রবার থেকে উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় থ্রি-জি ও ফোর-জি নেটওয়ার্ক পুনরায় চালু করে দেয়া হয়েছে। রোহিঙ্গাদের ইন্টারনেট ব্যবহারের আমরা বিপক্ষে নই। তবে যে প্রক্রিয়ায় ও যুক্তি তুলে ধরে ইন্টারনেট চালু করা হয়েছে আমরা তা মানতে নারাজ।

সর্বপ্রথম যখন ইন্টারনেট ব্যবহার নিয়ে সমালোচনা হচ্ছিল সেই সময় সাবেক টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী তারানা হালিম স্বয়ং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে উপস্থিত হয়ে শুধু টেলিটক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে নির্দিষ্ট বুথ থেকে ব্যবহারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কি কারণে তা বন্ধ করা হলো তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। এরপর রোহিঙ্গারা যখন ইন্টারনেট ব্যবহার করে জনসমাগম করলো তখন বিভিন্ন মহলের দাবির মুখে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া হলো।

আমরা বলতে চাই নেটওয়ার্ক বন্ধ করার পর বিটিআরসি’র একটি কমিটি উখিয়া ক্যাম্প পরিদর্শন করে। সেই সময় আমরাও বলেছিলাম মিয়ানমারের নেটওয়ার্ক দেশের অভ্যন্তরে ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। বিটিআরসি আইন অনুযায়ী দুই দেশের মধ্যে বৈঠক করে মিয়ানমারের নেটওয়ার্ক বন্ধ করতে পারে। কিন্তু তারা সে উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। তাই বিটিআরসি এর দায়ভার এড়াতে পারে না। সংশ্লিষ্টরা জানান, মোবাইল ফোন ব্যবহার করে আশ্রয় ক্যাম্পে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরি করছেন রোহিঙ্গারা। সিমের পাশাপাশি তারা ব্যবহার করছেন ইন্টারনেট সেবাও। এর মাধ্যমে গ্রুপ চ্যাটিং করে নিজেদের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান করছেন নিয়মিত। এক ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে এক জায়গায় লাখ লাখ রোহিঙ্গার জনসমাবেশ হওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। আর এসব সম্ভব হচ্ছে মোবাইল ফোন ব্যবহারের মাধ্যমে। নিয়ম অনুযায়ী কোনো রোহিঙ্গা বাংলাদেশের সিম ব্যবহার করতে পারেন না। কারণ সিম কিনতে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি লাগে। তার ওপর রয়েছে বায়োমেট্রিক পদ্ধতি।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, রোহিঙ্গাদের হাতে সিম ইস্যুতে সবাই যেভাবে দায়িত্ব এড়াতে চাচ্ছেন তা অত্যন্ত হাস্যকর। আগে ওই এলাকায় মোবাইল সিমের ব্যবহারকারী কতজন ছিল আর এখন কতজন হয়েছে সে হিসাবটা বের করলেই খুব সহজেই বিষয়টি বোঝা যাবে। পাহাড়ি এলাকায় সাধারণত এক কিলোমিটারের মধ্যে ৫০টির বেশি পরিবার থাকে না। সে হিসাবে তাদের হাতে কয়টা সিম থাকতে পারে আর এখন কতটা আছে?

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, স্থানীয়দের কাছ থেকে একেকটা সিম ৫০০ থেকে ১০০০ হাজার টাকার বিনিময়ে কিনছেন রোহিঙ্গারা। বিশেষ করে কর্পোরেট সিম সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করছেন রোহিঙ্গারা। এই সিম একজনের নামে অনেকগুলো দেয়ার সুযোগ রয়েছে। এটাই কাজে লাগাচ্ছেন অসাধুরা। বাড়তি টাকার বিনিময়ে ওইসব সিম তুলে দিচ্ছেন রোহিঙ্গাদের হাতে। তারা জানান, এখন রোহিঙ্গাদের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে। মুহূর্তের মধ্যে লাখ লাখ রোহিঙ্গা সমবেত হতে পারে। অদূর ভবিষ্যতে তারা যে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে না এ নিশ্চয়তা কে দেবে? এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যু। সরকার বা বিটিআরসি যদি এখনই কোনো ব্যবস্থা না নেয় তাহলে পরিস্থিতি হয়তো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। রাখাইনে মিয়ানমারের সেনাদের নির্যাতন হতে জীবন বাঁচাতে ২০১৭ সালের ২৫শে আগস্ট থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ঢল নামে।

কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে আশ্রয় নেন বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। নতুন-পুরনো মিলিয়ে এখন ১২ লাখের মতো রোহিঙ্গা কক্সবাজারে অবস্থান করছে। মানবিক কারণে বাংলাদেশ তাদের আশ্রয়ের পাশাপাশি সার্বিক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে। দেশি-বিদেশি এনজিওর পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকার তাদের খাদ্য, অস্থায়ী বাসস্থান, চিকিৎসা, বস্ত্র, লেখাপড়া, বিনোদনসহ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে।