শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের বেদনার ইতিহাস

কক্সবাজার জার্নাল ডটকম :

মানুষের জীবনে কত যে উত্থান আর পতনের ইতিহাস জড়িয়ে আছে; তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের জীবন। যা মর্মস্পর্শী এক বাণীতে ফুটে উঠেছে- ‘কিৎনা বদনসিব হ্যাঁয় জাফর…দাফনকে লিয়ে দোগজ জামিন ভি মিলানা চুকি ক্যোয়ি ইয়ার মে’।

কথাগুলো মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট জহিরুদ্দীন বাবরের ১৯তম উত্তরসূরী শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের। মৃত্যুর কিছুদিন আগে ভারত থেকে সূদুর রেঙ্গুনে নির্বাসিত অবস্থায় বেদনার্ত হয়ে লিখেছিলেন এই মর্মস্পর্শী বাণী।

সত্যি বড় দুর্ভাগ্য শেষ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের। নিজ ভূমিতে তার দাফনের জন্য দু’গজ মাটি, তাও মিলল না!

মোগল সাম্রাজ্যের পতনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাহাদুর শাহ জাফরের ব্যক্তিগত হাহাকার ও বেদনার ইতিহাস। বাহাদুর শাহ জাফরের জন্ম হয়েছিল ইতিহাসের এক যুগ সন্ধিক্ষণে। ব্রিটিশরা ততদিনে বাংলা বিহার উড়িষ্যা , মহীশূরসহ দেশীয় রাজ্য পদানত করে এগিয়ে যাচ্ছেন উত্তর ভারতের দিকে। ব্রিটিশ আগ্রাসনের থাবায় মোগল সম্রাটদের সার্বভৌমত্ব কোনঠাসা হয়ে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে দিল্লীর লাল কেল্লাতেই।

বাহাদুর শাহ জাফর জন্মেছিলেন দিল্লীর লাল কেল্লাতেই। ১৭৭৫ সালের ২৪ অক্টোবর। মা সম্রাজ্ঞী লাল বাঈ। পিতা মোগল বংশের ১৮তম সম্রাট দ্বিতীয় আকবর। পিতামহ সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম। লালকেল্লার পরিবেশে বেড়ে উঠেন স্বাধীন চেতা বাহাদুর শাহ জাফর। ব্যক্তিগতভাবে বাহাদুর শাহ জাফর একজন গুণী মানুষ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। একজন দক্ষ ক্যালিগ্রাফার, আধ্যাত্মিক কবি ও ধর্মীয় সাধক হিসেবে সবার শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন। এমন কী তিনি ব্রিটিশদের হাতে বন্দী থাকা অবস্থায় কাব্যচর্চায় সময় কাটাতেন। বলা চলে তিনি ছিলেন একজন উচ্চমানের কবি। তার অনেক কবিতা এখনো উচ্চারিত হয় মুখে মুখে।

মোগল সাম্রাজ্যের শোচনীয় অবস্থার মধ্যদিয়ে ১৮৩৭ সালে তার পিতার মৃত্যুর পর নানা নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে সিংহাসনে বসেন তিনি। তখন তার বয়স ৬২ বছর। পিতামহ মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের সময় থেকেই মোগল সম্রাটরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পেনশনভোগী। এরই মধ্যে মোগল কর্তৃত্ব একেবারেই শূন্যের কোটায়। মুদ্রা থেকে বাদ গেছে মোগল সম্রাটদের নাম। দিল্লীর নিয়ন্ত্রণও নেই মোগলদের হাতে। বাহাদুর শাহ জাফর মোগল সম্রাট হয়েও পেনশনভোগী হয়ে লালকেল্লায় দিনাতিপাত করতে থাকলেন।

১৮৫৭ সাল। ভারতের ইতিহাসের এক যুগ চিহ্নের বছর। এরই মধ্যে পলাশী যুদ্ধের পর একশত বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এই একশ বছরে শক্ত পোক্ত হয়েছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসন। ইংরেজদের অপশাসন, লুটপাট আর অত্যাচারে নিপীড়িত-নিষ্পেষিত মানুষের হাহাকার তখন চরমে। এমন সময় মুক্তির স্বপ্নে জেগে উঠল সিপাহী-জনতার। জ্বলে উঠল বিদ্রোহের আগুন। বিদ্রোহী সিপাহী-জনতা লাল কেল্লায় এসে সম্রাটকে অনুরোধ করলেন, ইংরেজদের জুলুম-অত্যাচারের বিরুদ্ধে এ বিদ্রোহের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে। লাল-কেল্লার মধ্যে আবদ্ধ সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের তখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ। তার বয়স তখন প্রায় ৮২ বছর। বৃদ্ধ সম্রাট বয়সের কারণে প্রথমে দায়িত্ব নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। কিন্তু, ভারতবর্ষে তখন তার চেয়ে সর্বজনবিদিত কিংবা গ্রহণযোগ্য নেতৃত্ব পাওয়া সম্ভব ছিল না। সিপাহীদের অনুরোধে অবশেষে রাজি হন তিনি।

বিদ্রোহী সিপাহী জনতার মধ্যে পড়ে যায় উৎসবের আমেজ। তারা বাহাদুর শাহ জাফরের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে শপথ নেন। গভীর রাতে ২১ বার কামানের তোপধ্বনির মাধ্যমে বৃদ্ধ সম্রাটকে ভারতবর্ষের স্বাধীন সম্রাট হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। সিপাহীরা একত্র হয়ে স্লোগান দেন, ‘খালক-ই খুদা, মুলক ই বাদশাহ, হুকুম-ই-সিপাহি’। অর্থাৎ, ‘দুনিয়া আল্লাহর, রাজ্য বাদশার, হুকুম সিপাহীর’।

বাহাদুর শাহ জাফর বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, এ সংবাদে উজ্জীবিত হয়ে লক্ষ্ণৌ, কানপুর, বারেলি, ঝাঁসি, বাংলা অঞ্চলসহ ভারতবর্ষে ওঠে বিদ্রোহের জোয়ার। এ যুদ্ধে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের তিন পুত্র- মির্জা মুঘল, মির্জা জওয়ান বখত ও মির্জা আবু বকর।

কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাস! সিপাহী বিদ্রোহ ব্যর্থতা ডেকে আনে। দেশীয় রাজন্যবর্গের অসহযোগিতা, অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র, অর্থাভাব, সামরিক দক্ষতার অভাবসহ নানা কারণে খেই হারিয়ে ফেলে সিপাহী-জনতার বিপ্লব। পাতিয়ালার রাজা কিংবা শিখদের মতো অনেকেই প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেয় ইংরেজদের পক্ষে। ইংরেজদের সমন্বিত আক্রমণের মুখে সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকেই দিল্লীর পতন মোটামুটি নিশ্চিতই হয়ে যায়।

১৮৫৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর, দিল্লীর লাহোরী গেট, সিকলাল কেল্লা, জামে মসজিদ ইত্যাদি অবস্থানে সিপাহীদের পতন ঘটে। এসব জায়গায় নৃশংসভাবে, নির্বিচারে হত্যা-লুণ্ঠন চালায় ইংরেজবাহিনী। সেদিন ভোরে লালকেল্লা ছেড়ে জাফর আশ্রয় নিলেন হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগায়। তিনি বুঝত পারলেন ‘বিদ্রোহীরা দুর্ভাগ্য বয়ে আনবে। মুঘল প্রদীপের আলো আর কয়েক ঘণ্টা পরেই শেষ হয়ে যাবে’।

বাহাদুর শাহ জাফরের আর লালকেল্লায় ফেরা হলো না। ইংরেজ সৈনিকরা তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। মোগল সম্রাজ্ঞী বেগম জিনাত মহল পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আত্মগোপনে চলে গেলেন সম্রাট হুমায়ুনের সমাধি সৌধে।

অপরদিকে লালকেল্লায় ততক্ষণে বিজয়ের তোপধ্বনি জানাচ্ছে ইংরেজ সৈন্যদের কামানের গোলা। জয় সমাপ্ত।

লালকেল্লার সম্রাট শাহজাহানের দিওয়ান-ই-খাসে চলছে বিজয়ী সৈন্যদের ডিনার, হুইস্কির গ্লাসে সম্রাজ্ঞী ভিক্টোরিয়ার নামে মদপান, ‘গড সেভ দ্য কুইন’।

সম্রাট হুমায়ুনের সমাধি সৌধে লুকিয়ে থাকা বাহাদুর শাহ জাফরকে এই দৃশ্য দেখতে হয়নি। ১৮৫৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ইংরেজ সেনাপতি হডসন তাকে ধরে নিয়ে এলেন লালকেল্লায়। প্রহরায় কেন্ডাল কোগিল নামে এক ইংরেজ সেনা। ‘হিন্দুস্থানের রাজা এখন আমার বন্দি’। ততক্ষণে সম্রাটের দুই ছেলেকে নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়ে সম্রাট হুমায়ুনের কবর থেকে বের করে এনেছেন হডসন, এবং মাঝরাস্তায় তাদের উলঙ্গ করে গুলি করে মারা হয়। খবর পেয়ে বাহাদুর শাহ জাফর স্তম্ভিত, অনেকক্ষণ কথা বলতে পারেন নি।

১৮৫৮ সালের জানুয়ারিতে শুরু হলো রাজদ্রোহের অভিযোগে তার বিচার। শীতের সকাল, অশতীপর বৃদ্ধ মাঝে মাঝে দিওয়ান-ই-খাসের বিচারালয়ে ঘুমিয়ে পড়েন, কিছু না বুঝে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। রোজকার খাওয়াদাওয়ার জন্য বরাদ্দ দু’আনা। আগে অনুমতি ছাড়া উজির থেকে আমির কেউ আসতে পারতেন না তার সামনে। আর এখন তিনি উঠতে বসতে ইংরেজ প্রহরীদের সালাম দেন। যে ইংরেজ বণিকদের তার পূর্বপুরুষ সম্রাট জাহাঙ্গির একদিন এই দেশে ব্যবসার অধিকার দিয়েছিলেন। তারাই আজ বিচারক!

১৮৫৮ সালের মার্চ মাসে প্রহসনের বিচারে বাহাদুর শাহ জাফরের সাজা ঘোষণা হলো: নির্বাসন। আন্দামান, দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ কলোনি…গভর্নর জেনারেল যেখানে ভালো বুঝবেন!

১৮৫৭ সালের ৭ অক্টোবর ভোর তিনটায় জেলার ওমনি সাহেব বৃদ্ধকে ডেকে তুললেন, ‘চলুন, যেতে হবে’। পরিবারের ৩১ জনকে সঙ্গে নিয়ে দিল্লির রাস্তা ধরে এগিয়ে গেল পাল্কি ও মোষের গাড়ি। পাহারায় কোম্পানির ৯ নম্বর ল্যান্সারবাহিনী। একদা পানিপথের যুদ্ধে জিতে তার পূর্বপুরুষ সম্রাট বাবর তৈরি করেছিলেন মুঘল সাম্রাজ্য। ৩৩২ বছর পরে সেই ইতিহাস ছেড়ে ভোর হওয়ার আগেই বেরিয়ে যেতে হলো তাকে।

এলাহাবাদে পৌঁছানোর পর ওমনিকে বড়লাট ক্যানিং জানালেন, বন্দিদের নিয়ে যেতে হবে রেঙ্গুন!

শুরু হলো বাহাদুর শাহ জাফরের রেঙ্গুন জীবন। ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় ছোট ছোট ৪টি ঘর। একটায় সম্রাট, অন্যটিতে বেগম জিনাত মহল, আর বাকি দুটোয় সস্ত্রীক দুই ছেলে। দিনের বেলায় মাস্কেট হাতে দু’জন পাহারাদার, রাতে তিন জন। জাফরকে কাগজ-কলম দেওয়াও নিষিদ্ধ। বিষণ্ণ নির্বাসিত সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর গড়গড়ার নল মুখে দিয়ে শুয়ে থাকেন, কখনো কখনো রেঙ্গুন নদী থেকে বাতাস এসে উলোট পালোট করে দেয় সমস্ত কিছু।

আয়েশি জীবনযাপনে অভ্যস্ত বাহাদুর শাহের শেষ দিনগুলো কাটতে থাকে নিঃসঙ্গতা, কষ্ট আর মানসিক যন্ত্রণায়। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে মুঘল সালতানাতের হতভাগ্য সম্রাট দৈনিক ১১ টাকা বরাদ্দে দিনাতিপাত করতে লাগলেন সেই পরিত্যক্ত কাঠের ঘরটিতে। দেখতে দেখতে সময় গড়িয়ে যায়।

১৮৬২ সালের ২৬ অক্টোবর তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। মৃত্যু তখন শুধু সময়ের অপেক্ষামাত্র! অবশেষে ১৮৬২ সালের ৭ নভেম্বর তিনি নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। তিনি তার মৃত্যু সম্পর্কে লিখেছিলেন-

‘আমার কোনো বন্ধু আসেনি, যখন সময় এল।

মৃত্যুকে প্রশংসা করতেই হয়,

কারণ সে একাই যথাসময়ে এল,

ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’।

তার মৃত্যুতে ইংরেজ শাসকরা আপদ বিদেয় হয়েছে মনে করলো। গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং জানালেন, ‘ভবিষ্যতে এই সব প্রাক্তন সম্রাট, মুঘল রাজা গোছের শব্দ ব্যবহার করবেন না। স্টেট প্রিজনার লিখবেন’। তার সম্বন্ধে সম্রাট শব্দটা বারংবার মুছে ফেলতে চেয়েছে ইংরেজ। ইতিহাস কিন্তু ঠিকই তাকে মনে রেখেছে মোগল সাম্রাজ্যের শেষ অধিপতি হিসেবে, যিনি স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন স্বাধীনতার। পুনর্জাগরণের।

সেই ইতিহাস লেখা হলো ১৯০৭ সালে রেঙ্গুনের সাদামাটা এক দরগায়। ধন্যাঢ্য আভিজাত্য বিহীন রেঙ্গুনের জি ওয়াকাওয়াস্ট্রিটের দরগায় বসানো হলো ভিত্তি প্রস্তর। যেখানে লেখা হলো- ‘দিল্লির প্রাক্তন রাজা বাহাদুর শাহ এখানে মারা গিয়েছিলেন, সন্নিকটে তার সমাধি’। পরে সেই ফলকের কাছেই তৈরি হলো টিনের চালার ছোট্ট মাজার। বাহাদুর শাহের সমাধিস্থল!

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই রেঙ্গুনের মাঠ থেকে ব্রিটিশ বিতাড়িত হয়েছিল। এই মাঠেই তাঁবু ফেলেছিল আজাদ হিন্দ ফৌজ। আশা- আকাঙ্খা আর মুক্তির প্রতীক হয়েই তাদের অনুপ্রেরণা দিচ্ছিলেন শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর!

১৯৮৭ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজিব গান্ধী, বাহাদুর শাহ’র সমাধি পরিদর্শনে গিয়ে সম্রাটের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে পরিদর্শকদের জন্য রক্ষিত বইয়ে মন্তব্য করেন-

দু’গজ জমিন তো না মিলি হিন্দুস্তাঁ মে,

পার তেরি কুরবানি সে উঠি আজাদি কি আওয়াজ।

বদ-নসিব তো নেহি জাফর,

জুড়া হ্যায় তেরা নাম ভারত শান আউর শওকত মে,

আজাদি কি পয়গাম সে।।

রাজিব গান্ধীর মন্তব্যের অনুবাদ হলো- ‘হিন্দুস্তানে তুমি দু’গজ মাটি পাও নি সত্য। তবে তোমার আত্মত্যাগ থেকেই আমাদের স্বাধীনতার আওয়াজ উঠেছিল। দুর্ভাগ্য তোমার নয় জাফর, স্বাধীনতার বার্তার মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষের সুনাম ও গৌরবেরর সঙ্গে তোমার নাম চির স্মরণীয় হয়ে রয়েছে’।