২৯ এপ্রিল আসলে আতঁকে উঠে উপকূলবাসী

মোহাম্মদ হিজবুল্লাহ, পেকুয়া

পেকুয়া উপজেলার মগনামা ইউনিয়নের শরৎঘোনা এলাকার রহমত উল্লাহ (৬৩) ও হোসনে আরা (৫৫) দম্পতি। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস ম্যারি এনের আঘাতে হারিয়েছেন ৮ সন্তানকে। সাগরের পানিতে ভেসে গেছে রহমত উল্লাহর মাসহ আরো অনেক নিকটাত্মীয়। সেই প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড়ের দুঃসহ স্মৃতি বুকে নিয়ে কাটিয়েছেন তারা দীর্ঘ ২৮টি বছর।

সেই স্মৃতি হাতড়ে রহমত উল্লাহ বলেন, সেদিন সন্ধ্যা নামার সাথে বাড়তে থাকে বাতাসের গতিবেগ। সন্ধ্যার পর থেকে বাড়তে শুরু করে সাগরের পানি। শুরু হয় উপকূলবাসীর উৎকন্ঠার রাত। রাত ৮ টার দিকে বাতাসের গতিবেগ কিছুটা বেড়ে যায়। সেসাথে গর্জে উঠে সাগর। সাগর উপকূলের লোকজন ছোটাছুটি শুরু করে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। কেউ কেউ আশ্রয় নেয় আশ্রয় শিবিরে। চাহিদার তুলনায় আশ্রয় কেন্দ্র ছিল খুব অপ্রতুল। রহমত উল্লাহর পরিবারে সদস্য সংখ্যা বেশি হওয়ায় আশ্রয় শিবিরে যেতে পারিনি। ঘূর্ণিঝড়ের কয়েকদিন আগে জীবিকার খুঁজে গিয়েছিলাম খাটখালীতে। স্ত্রী হোসনে আরা ৬ ছেলে ও ২ মেয়েকে নিয়ে শরৎঘোনা এলাকার বাড়িতেই ছিল। ছোট বাচ্চাদের নিয়ে সে দূরের আশ্রয়ণ কেন্দ্রে যেতে পারেনি। তাই আমার মাও তাকে ছেড়ে যায়। ফলাফল একমাত্র স্ত্রী ছাড়া সবাইকে কেড়ে নিলো রাক্ষুসে দরিয়া।

হঠাৎ প্রচন্ড বাতাসের সাথে সাগরের উচুঁ ঢেউ একের পর এক আছড়ে পড়ে উপকূলে। এক সময় বাতাসের গতি আরো বেড়ে যায়। সে সাথে বাড়ে পানির উচ্চতা। পানির একেকটি ঢেউ হয়ে ওঠে পর্বত সমান। এভাবে ঢেউয়ের আঘাতে বসতবাড়ি মুহূর্তেই চুরমার হয়ে ভেসে যায় ৯মাসের শিশুসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা। আমার স্ত্রী হোসনে আরা প্রবল বাতাস আর পানির ঢেউয়ে স্রোতে দুই কিলোমিটার ভেসে গিয়ে প্রাণে বেঁচে যায়।

এই দুঃসহ রাত শেষে ভোরের দিকে বাতাসের গতিবেগ কমে যায়। সাথে কমে যেতে থাকে পানির ঢেউ। এরইমধ্যে প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস ম্যারি এন তছনছ করে দিয়েছিল উপকূলীয় জনপদ। নিহত হয়েছিল কয়েক লাখ মানুষ। ভেসে গিয়েছিল ফসলের ক্ষেত, লাখ লাখ গবাদি পশু। খাটখালীতে থেকে আমি ফিরে এসে দেখি বাড়িঘরের কোন চিহ্ন নেই। বাড়ির অদূরে পাওয়া যায় আমার মায়ের নিথর দেহ।

রহমত উল্লাহর স্ত্রী হোসনে আরা বলেন, ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ৮ সন্তানসহ অনেক নিকট আত্মীয়কে হারিয়েছি। হারিয়েছি সহায় সম্পদ। সেই দুঃসহ স্মৃতির প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড়ের আটাশ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো নিরাপদ মনে করতে পারছিনা নিজেকে বা নিজের পরিবারকে। উপকূলের অধিকাংশ বেড়িবাঁধ এখনো অরক্ষিত। উজাড় করা হয়েছে প্যারাবন। বিগত আট বছরে তিনবার পড়তে হয়েছে ভয়াবহ বন্যার কবলে। আগামী বর্ষার প্রথম ধাক্কাতেই তলিয়ে যেতে পারে বসতঘর। বেড়িবাঁধের সংস্কার কাজ চললেও এখনো অরক্ষিত রয়ে গেছে উপকূল।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পেকুয়া উপজেলার উজানটিয়া ইউনিয়নের ৩১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে করিয়ারদিয়া, টেকপাড়া ও রূপালি বাজার এলাকায় অরক্ষিত রয়েছে ৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। মগনামা ইউনিয়নের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে কাকপাড়া ও শরৎ ঘোনা এলাকায় ২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ অরক্ষিত। যা নিয়ে উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে স্থানীয় বাসিন্দাদের মাঝে।

মগনামা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শরাফত উল্লাহ ওয়াসিম বলেন, চাষাবাদ, লবণ ও চিংড়ী উৎপাদনে নির্ভরশীল উপকূলের এসব মানুষ। কিন্তু প্রাকৃতিক বিভিন্ন দুর্যোগে বিপর্যস্ত হয়ে তাদের উপার্জনের ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে যাওয়া এবং এ এলাকায় দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়ন তুলনামূলক কম হওয়ায় পরিবার পরিজন নিয়ে অন্যত্র পাড়ি জমাচ্ছেন তারা। গত এক বছর আগেও বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে সাগরে পানি লোকালয়ে চলে আসে। এতে অধিকাংশ মানুষ রমজান মাসে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহায়। ঈদের নামাজ পড়তে পারেনি এ ইউনিয়নের মানুষ। উপকূলীয় অ লের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিতে বেড়িবাঁধের এসব অংশের সংস্কার করা অতীব জরুরী।

উজানটিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম বলেন, বেড়িবাঁধ নিয়ে উপকূলবাসীর দুর্ভোগের অন্ত নেই। গত কয়েকবছর ধরে পাওয়া কষ্ট লাগবে সম্প্রতি বেড়িবাঁধ সংস্কারে বিপুল বরাদ্দ দেয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু প্রয়োজনীয় বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের খামখেয়ালিপনায় আমার ইউনিয়নে ২কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়ে গেছে অরক্ষিত। আগামী ২০ দিনের মধ্যে যদি এসব বেড়িবাঁধ সংস্কার করা না হয়, তবে আবারো সাগরের নিয়মিত জোয়ারের পানি প্রবেশ করবে লোকালয়ে। ভেঙ্গে পড়বে এখানকার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও গ্রামীণ অবকাঠামো।

এব্যাপারে পেকুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহবুবউল করিম বলেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে সংস্কারকাজ শেষ করতে ঠিকাদারদের তাগাদা দেয়া হয়েছে। পেকুয়া উপজেলাবাসীর কথা চিন্তা করে বিষয়টি আমি ব্যক্তিগতভাবে তদারকি করছি। আশা করছি খুব কম সময়ের মধ্যে বেড়িবাঁধ সংস্কারকাজ শেষ হবে।