ইয়াবা চোরাচালান: নৌপথে আসে, বিমানবন্দর দিয়ে যায়

মোহাম্মদ জামিল খান, ডেইলী স্টার •


গত দুই বছর ধরে প্রত্যেক মাসেই বিমানবন্দর দিয়ে লাগেজের ভেতরে লুকিয়ে ইয়াবা পাচার করে আসছেন মাদক চোরাকারবারিরা।

মাদকবিরোধী কর্মকর্তা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, চোরাচালানের মাধ্যমে দেশের বিমানবন্দর দিয়ে যাওয়া ইয়াবাগুলোর বেশিরভাগই যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ, মধ্যপ্রাচ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র বলছে, ইয়াবার বড় চালানগুলো মূলত মিয়ানমার থেকে নাফ নদী হয়ে কক্সবাজার ও টেকনাফে প্রবেশ করে। এরপর সেখান থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ও বিমানবন্দর দিয়ে বিদেশে যায়।

গ্রেপ্তারকৃত মাদক চোরাকারবারিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও আরও বেশ কয়েকজনের ওপর নজরদারি করে তারা জানতে পেরেছেন, মিয়ানমার থেকে আনা এসব ইয়াবা চোরাচালানে বেশ কয়েকটি গ্রুপ জড়িত ছিল।

বিমানবন্দরে ৩ডি স্ক্যানার না থাকায় ওই গ্রুপগুলো বিদেশি কুরিয়ার বা ডাক পরিষেবার মাধ্যমে সহজেই মাদক চোরাচালান করতে পারে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) ও পুলিশের ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম-ফাইটিং ইউনিটের সাম্প্রতিক অনুসন্ধানের তথ্য অনুযায়ী, ইয়াবার এসব ব্যাগগুলো বিদেশে যাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট শিপিং কোম্পানি বা বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করে থাকে।

ডিএনসির এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, ‘যদি ডিএনসির বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তারা ওইসব ব্যাগগুলো পরীক্ষা না করে বা অত্যাধুনিক স্ক্যানার ব্যবহার করা না হয়, তাহলে ব্যাগে থাকা ইয়াবা শনাক্ত করা বেশ কষ্টসাধ্য।’

আবার অনেক সময় ইয়াবা চোরাকারবারিরা অভিবাসী শ্রমিকদের সঙ্গে ছলচাতুরি করে তাদের মাধ্যমেই এগুলো পাঠিয়ে থাকে।

গত মাসে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় নিয়োজিত কর্মকর্তারা পোশাক কারখানার জিনিসের একটি বাক্সের ভেতরে প্রায় ৩৯ হাজার ইয়াবা পেয়েছিল। সেই বাক্সটি কার্গোবিমানে করে সৌদি আরবে পাঠানো হচ্ছিল।

তদন্তকারী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পরবর্তীতে এর সঙ্গে জড়িত থাকায় সন্দেহভাজন হিসেবে পাঁচ জনকে গ্রেপ্তার করেছে ডিএনসি কর্মকর্তারা।

নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে ডিএনসির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের কাছে আরও সাত জনের পরিচয় রয়েছে, যাদের মধ্যে একজন ইয়াবা চোরাচালানকারী একটি দলের প্রধান। বিমানবন্দরের ক্লিয়ারিং ও ফরওয়ার্ডিং এজেন্টদের সঙ্গে চোরাকারবারিদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।’

তিনি বলছিলেন, গত ১ জুন থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ১৪টি চোরাচালান থেকে অন্তত ২১ হাজার ৬১৪টি ইয়াবা উদ্ধার করেছে ডিএনসি কর্মকর্তারা। এ ঘটনায় নয়টি মামলা ও চারটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে।

সেপ্টেম্বরে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গোতে করে অস্ট্রেলিয়ায় পাঠানোর জন্য বুক করা প্যাকেট থেকে প্রায় সাড়ে ১২ কেজি অ্যাম্ফিটামিন উদ্ধার করেছিল।

ইয়াবা চোরাচালানের সঙ্গে ক্লিয়ারিং ও ফরওয়ার্ডিং এজেন্টদের জড়িত থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা এয়ারপোর্ট সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি ফারুক আহমেদ বলেন, ‘কোনো এজেন্ট জেনেশুনে ইয়াবা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত, এটি আমি বিশ্বাস করি না। এজেন্টদের অগোচরে এটা হতে পারে।’

তিনি জানান, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা প্রয়োজনীয় নথি প্রস্তুত করে থাকে এবং কাস্টমস কর্মকর্তাদের সামনে প্যাকেজগুলো খুলে পরীক্ষা করে থাকে।

‘বিমানবন্দর থেকে ৩৯ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধারের পর কাস্টমস কর্মকর্তা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে আমরা বৈঠক করেছি। বিমানবন্দরে আরও স্ক্যানার বসানোর জন্য আমরা বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কাজ করছি’, বলেন ফারুক আহমেদ।

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এএইচএম তৌহিদ-উল আহসান সম্প্রতি বলেন, ‘চলতি বছর অ্যাম্ফিটামিন ও ইয়াবা উদ্ধারের পর থেকে বিমানবন্দরের চেকিং ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।’

‘আমরা আরও সিসিটিভি ক্যামেরা লাগাব, যাতে বিমানবন্দরের প্রতিটি ইঞ্চি এর আওতায় থাকে। একইসঙ্গে বিমানবন্দরে দক্ষ জনবলের সংখ্যা বাড়াতে আমরা কাজ করছি’, বলেন তিনি।

এএইচএম তৌহিদ-উল আহসান আরও বলেন, ‘বিমানবন্দরে প্রতিটি প্যাকেজ চেক করার জন্য আরও ১১টি এক্স-রে মেশিন কেনার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এক্স-রে মেশিনগুলো চলতি অর্থবছরের মাঝামাঝি নাগাদ চালু করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।’

তদন্তকারী কর্মকর্তারা বলছেন, উদ্ধার করা ৩৯ হাজার পিস ইয়াবার প্রাপকের বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে তারা জানতে পেরেছেন যে, প্যাকেজে লিখা ঠিকানাটির কোনো অস্তিত্বই নেই।

ডিএনসির আরেক কর্মকর্তা বলেন, এর সঙ্গে বেশ কয়েকজন বিদেশি নাগরিকও জড়িত। তাদের সন্ধান পেতে আমরা ইন্টারপোলের কাছে সহায়তা চাওয়ার পরিকল্পনা করছি।’

ডিএনসির অতিরিক্ত পরিচালক (ইন্টেলিজেন্স) মোসাদ্দেকুল হোসেন রেজা বলেন, ‘আমরা শিগগিরই সন্দেহভাজনদের গ্রেপ্তার করতে পারব বলে আশাবাদী।’

পুলিশের গোয়েন্দা শাখার ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, গত এক বছরে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে সৌদি আরব, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, বাহরাইন, ইরাক ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলোতে পাঠানো বিভিন্ন পণ্যের মধ্যে অন্তত ১০টি চালানের মধ্যে ইয়াবা লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।

তিনি জানান, পুলিশ জানতে পেরেছে যে, চলতি বছরের এক মাসেই সিঙ্গাপুরে এমন পাঁচটি চালান পাঠানো হয়েছে। ‘আমরা আমাদের সতর্কতা বাড়িয়েছি’, বলেন তিনি।

গত ৭ ডিসেম্বর গোয়েন্দা ও পোস্টাল সার্ভিস কর্মকর্তারা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো কমপ্লেক্সে জিনস প্যান্টের প্যাকেজের একটি চালান থেকে দুই হাজার ৪০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করে। পরে এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে রাজধানীর খিলগাঁও এলাকা থেকে চার জনকে গ্রেপ্তার করেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। ওই চালানটি যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানোর কথা ছিল।

গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর সৌদি আরবে যাওয়ার সময় চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ১০ হাজার ৬০০ পিস ইয়াবাসহ এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।

এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জুন থেকে ডিসেম্বরের মধ্যকালীন বিভিন্ন সময়ে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে ইয়াবাসহ পাঁচ জনকে আটক করা হয়েছিল।

২০১৯ সালের ৫ জানুয়ারি চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের সঙ্গে এক বৈঠকে প্রবাসী প্রতিনিধিরা বলেছিলেন, মাদক চোরাকারবারিরা প্রতারণার মাধ্যমে ‘নিরীহ’ অভিবাসীদের দিয়ে ইয়াবা বহন করাচ্ছে।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, বিগত কয়েক বছরে বিভিন্ন দেশে যাওয়ার পর লাগেজে ইয়াবা থাকায় গ্রেপ্তার হয়েছেন বাংলাদেশি নাগরিকরা।

ডিএনসির পরিচালক (অপারেশন্স অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স) কুসুম দেওয়ান বলেন, ‘ভৌগলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশকে মাদক চোরাচালানের রুট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিল।’

‘এই নেটওয়ার্ক উন্মোচনে আমরা কাজ করছি’, যোগ করেন তিনি।