কক্সবাজার থেকে ইয়াবা পাচারে ব্যবহার হচ্ছে দূরপাল্লার যাত্রীবাহী বিলাসবহুল বাস

ফাইল ছবি

ডেস্ক রিপোর্ট – কক্সবাজার থেকে মাদক চোরাচালানে যাত্রীবাহী দূরপাল্লার বাস, পণ্যবাহী ট্রাক ও মাইক্রোবাসের মতো যানবাহনের ব্যবহার বেড়ে চলেছে। চালক ও তার সহকারীর সঙ্গে আঁতাত করে এসব যানবাহনে ইয়াবাসহ নানা ধরনের মাদক দেশের এক জেলা থেকে অন্য জেলায় পাচার করছে মাদক ব্যবসায়ীরা।

এ কাজ করতে গিয়ে প্রায় সময়ই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হচ্ছেন মোটরযানের চালক ও তার সহকারী, জব্দ হচ্ছে যানবাহন।

র‌্যাবের পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত মাদক পাচারে ব্যবহূত বিভিন্ন শ্রেণীর ১২২টি যানবাহন জব্দ হয়েছে। এর মধ্যে গ্রিনলাইন, হানিফ, শ্যামলী, সোহাগ, দেশ ট্রাভেলস, লন্ডন এক্সপ্রেসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিলাসবহুল বাস রয়েছে ৩১টি।

পণ্য পরিবহনের কাভার্ড ভ্যান ও ট্রাক রয়েছে ৭৬টি। পাজেরো, মাইক্রোবাস এবং প্রাইভেট কারের মতো ব্যক্তিগত ব্যবহারের যানবাহন রয়েছে ৫৬টি।

অধিকাংশ যানবাহনই কক্সবাজার থেকে ইয়াবার চালান নিয়ে ঢাকায় আসার পথে চট্টগ্রামে র‌্যাব-৭-এর অভিযানে জব্দ হয়েছে।

সর্বশেষ গত ২৬ জুন শ্যামলী পরিবহনের একটি হুন্দাই ব্র্যান্ডের ইউনিভার্স সিরিজের বিলাসবহুল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস রাজধানীর সায়েদাবাদ থেকে জব্দ করে র‌্যাব।

কক্সবাজার থেকে ছেড়ে আসা এ বাসটির চালক আবদুল হালিমের হেফাজত থেকে উদ্ধার করা হয় সাত হাজার পিস ইয়াবা।

ইয়াবা পাচারের কাজে আবদুল হালিমকে সহযোগিতা করতেন ওই বাসেরই হেলপার রনি মিয়া। তাকেও গ্রেফতার করে র‌্যাব। শুধু এ বাসটিই নয়, গত দুই বছরে শ্যামলী পরিবহনের আটটি বিলাসবহুল বাস মাদক মামলার আলামত হিসেবে জব্দ হয়েছে।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কর্নেল এমরানুল হাসান বলেন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তত্পরতার মুখে মাদক পাচারের জন্য পরিবহন খাতকে বেছে নিয়েছে মাদক ব্যবসায়ীরা।

তারা মোটা অংকের টাকার প্রলোভনে ফেলে চালক ও সহকারীদের মাধ্যমে বিলাসবহুল বাসেও মাদক পাচারের চেষ্টা করছে। কিন্তু নিয়মিত অভিযানের কারণে তাদের সে চেষ্টা সফল হচ্ছে না। উল্টো মাদক পাচারের অপরাধে যানবাহনের চালক ও সহকারীরা গ্রেফতার হচ্ছে। মামলার আলামত হিসেবে যানবাহনগুলোও জব্দ করা হচ্ছে।

জানা গেছে, মামলার আলামত হিসেবে জব্দ হওয়া এসব যানবাহনের মধ্যে কিছু বাস মালিকের মুচলেকা সাপেক্ষে বাণিজ্যিক কার্যক্রমে যুক্ত হতে পারলেও স্থায়ীভাবে আটকে থাকছে ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান। মামলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত জব্দ থাকায় একদিকে এসব যানবাহনের আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে আসছে, অন্যদিকে বাড়ছে এর বিপরীতে নেয়া ঋণের সুদ।

পরিবহন মালিকরা বলছেন, তাদের অজ্ঞাতসারেই চালক ও তার সহকারীরা বাস, ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানে মাদক পাচার করে থাকেন। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে ধরা পড়ার পর তাদের পাঠানো হয় কারাগারে। আর যানবাহনগুলো মামলার আলামত হিসেবে জব্দ করা হয়। মামলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত এসব যানবাহন আদালতের হেফাজতে সংরক্ষিত থাকে।

মাদকের মামলাগুলো শেষ হতে অন্তত ৩ থেকে ১০ বছর সময় লেগে যায়। কিছু ক্ষেত্রে এরও অধিক সময়ের প্রয়োজন হয়। সেক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় জব্দ থাকা যানবাহনগুলোর আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে যায়। পাশাপাশি ব্যাংক লোনের মাধ্যমে কেনা এসব যানবাহনের কিস্তিও ঠিকমতো পরিশোধ করতে পারেন না তারা।

শ্যামলী পরিবহনের স্বত্বাধিকারী ও বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রমেশ চন্দ্র ঘোষ এ বিষয়ে বলেন, মামলার আলামত হিসেবে বাস জব্দ করা হলে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়তে হয়। বিলাসবহুল শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িগুলো সাধারণত ব্যাংকঋণের মাধ্যমে কেনা হয়। বাসের আয়ের টাকা থেকে ব্যাংকের কিস্তি পরিশোধ করা হয়। কিন্তু বাসগুলো মামলার আলামত হিসেবে জব্দ থাকলে ব্যাংকঋণের কিস্তির টাকাও আটকে যায়। অনেক ক্ষেত্রে ঋণখেলাপিও হতে হয় পরিবহন মালিকদের।

র‌্যাব সদর দপ্তরের দেয়া তথ্যমতে, মূলত ২০১৬ সাল থেকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তল্লাশি এড়াতে বিলাসবহুল বাসে ইয়াবা পাচার শুরু হয়।

ওই বছর ১৪ ও ১৫ জানুয়ারি কক্সবাজার থেকে ছেড়ে আসা সৌদিয়া পরিবহনের দুটি বাসে তল্লাশি করে ২৬ হাজার ৫১০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়।

ইয়াবা বহনের দায়ে গ্রেফতার করা হয় বাস দুটির চালক, চালকের সহকারী এবং সুপারভাইজারকে। আর মামলার আলামত হিসেবে জব্দ করা হয় বাস দুটি। একই বছর সালমা এন্টারপ্রাইজের একটি বাস মাদক পাচারের দায়ে জব্দ করা হয়। এছাড়াও ওই বছর মাদক পাচারের অপরাধে জব্দ করা হয় পণ্য পরিবহনের পাঁচটি কাভার্ড ভ্যান ও ট্রাক এবং পাঁচটি ব্যক্তিগত গাড়ি।

২০১৭ সালে এসে এ সংখ্যা বেড়ে যায় দ্বিগুণেরও বেশি। ওই বছরের ১৩ মার্চ ইয়াবা পাচারের সময় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে জব্দ হয় হানিফ পরিবহনের একটি বাস। এরপর পর্যায়ক্রমে ১৮ আগস্ট শ্যামলী পরিবহনের একটি এসি বাস, ২৫ আগস্ট আবদুল্লাহ এন্টারপ্রাইজের একটি বাস, ৩ নভেম্বর দেশ ট্রাভেলস, ১৫ নভেম্বর শ্যামলী পরিবহন, ১৬ নভেম্বর গ্রিনলাইন পরিবহন, ১৭ নভেম্বর দেশ ট্রাভেলস, ২৫ নভেম্বর তুবা লাইন এলিট পরিবহন, ৩০ নভেম্বর গ্রিনলাইন পরিবহনের একটি বাস র‌্যাবের অভিযানে জব্দ হয়।

কক্সবাজার থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসা হানিফ পরিবহনের একটি বাস থেকে ২০১৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ইয়াবার একটি চালান উদ্ধার করে র‌্যাব-৭। এ মাদক পাচারে সম্পৃক্ততার দায়ে গ্রেফতার করা হয় বাসের চালক, চালকের সহকারী ও সুপারভাইজারকে। মামলার আলামত হিসেবে জব্দ করা হয় বাসটি।

একই বছরের ৩ মার্চ কক্সবাজার থেকে আসা আরেকটি বিলাসবহুল বাসের এক নারী যাত্রীর কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ৯ হাজার ৬৫০ পিস ইয়াবার একটি চালান। তবে বাসের কোনো স্টাফ ইয়াবা পাচারে সম্পৃক্ত না থাকায় বাসটি জব্দ করা হয়নি।

৬ জুন কক্সবাজার থেকে আসা শ্যামলী পরিবহনের একটি বিলাসবহুল বাস থেকে উদ্ধার করা হয় ৩৩ হাজার ৫৫০ পিস ইয়াবার একটি চালান। গ্রেফতার করা হয় বাসের চালক ও তার সহকারীকে। মামলার আলামত হিসেবে জব্দ করা হয় বাসটি। এর ১৫ দিন পর অর্থাৎ ২৫ জুন ও ২৯ জুন শ্যামলী পরিবহনের আরো দুটি বাস থেকে উদ্ধার করা হয় ইয়াবার চালান। দুটি বাসই মামলার আলামত হিসেবে জব্দ করা হয়।

১৯ জুলাই তুবা লাইনের একটি বাস থেকেও উদ্ধার করা হয় ইয়াবার চালান। চালক ও তার সহযোগীকে গ্রেফতারের পাশাপাশি জব্দ করা হয় বাসটি।

গত দেড় বছরে মাদক মামলার আলামত হিসেবে হানিফ পরিবহনের চারটি বিলাসবহুল বাস জব্দ করা হয়েছে।

হানিফ পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোশারফ হোসেন বলেন, জব্দ হওয়া বাসগুলো ছাড়ানোর ক্ষেত্রে বেশ বড়সড় আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। মামলাটি তদন্ত শেষ হওয়ার পর থানা থেকে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। এরপর আদালতে মুচলেকা দিয়ে বাসগুলো ছাড়াতে হয়। সব মিলিয়ে এ প্রক্রিয়া শেষ করতে প্রায় তিন মাস বা এরও বেশি সময় লেগে যায়। এর পরও যেসব বাসের যন্ত্রাংশ থেকে মাদক উদ্ধার করা হয়, সেগুলো মুচলেকা প্রযোজ্য হয় না।