রমজান ঐতিহাসিক যেসব ঘটনার সাক্ষী

ইসলামে রমজান মাসের গুরুত্ব অপরিসীম। রমজান মাস ইসলাম ও মুসলিম জীবনে ব্যাপক পরিবর্তনের মাস। এই মাসে মুসলিমরা যেমন আত্মিক পরিশুদ্ধি লাভ করে তেমনি করে বাহ্যিক পরিশুদ্ধিও লাভ করে।

এই মাস যেমন করে মুমিন অন্তরে শান্তি কল্যাণের বার্তা দেয়, তেমন করে এই মাস ইসলাম রাষ্ট্র ও সমাজে শান্তি ও কল্যাণের বার্তা দেয়। এই মাসে মুমিনরা আল্লাহর শক্তি অর্জন করে তাগুতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লাফিয়ে পড়ে। এই মাসে মুসলমান অন্য মাসের তুলনায় বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। কেননা এই মাসে মুসলমানরা আল্লাহর অধিক নিকটে চলে যায়। এই মাসেই সাধিত হয় ইসলাম ও মুসলমানদের বড় বড় বিজয়গুলো। যদিও এই মাস উপবাস করার মাস। কিন্তু ইসলামের ইতিহাসে এই মাসে সবচে বেশি যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে এবং বড় বড় বিজয়গুলো এই মাসেই অর্জিত হয়েছে। এই মাসে বড় বড় বিজয় কিভাবে অর্জিত হয়েছে? এর সুন্দর ও সহজ উত্তর হলো এই মাসে মুসলমান আল্লাহর দিকে অন্যান্য সময়ের তুলনায় বেশি প্রত্যাবর্তন করে, আর বান্দা যখন আল্লাহমুখী হয়ে যায় তখন বিজয় অবধারিত। এই রকম কয়েকটি যুদ্ধ যা রমজান মাসে সংগঠিত হয়েছে তার বিস্তারিত আলোচনা করবো ইনশাল্লাহ!

বদর যুদ্ধ
ইসলামের ইতিহাসের প্রথম ও প্রধানতম যুদ্ধ। যেই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর বুকে ইসলাম স্থিরতা পায়। যে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে তাগুত ও বেঈমান শক্তি চেয়ে ছিল ইসলামের নাম নিশানা দুনিয়া থেকে মুছে দিতে। কিন্তু ঘটনা ঘটলো উল্টো। এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে স্থায়ীভাবে স্থাপিত হলো ইসলাম ও মুসলমান। বদর যুদ্ধের বিজয় দিয়েই ইসলামের বিজয় যাত্রা শুরু। আর এ বিজয় যাত্রা শুরু হয়েছিল এই রমজান মাসেই। শুধু বদর নয়, পর্যায়ক্রমে আমরা রমজানে সংঘটিত যুদ্ধগুলো আলোচনা করবো।

বদর যুদ্ধের সংক্ষিপ্ত বিবরণ
২য় হিজরির ১৭ই রমজান এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নবুয়াতি প্রাপ্তির পর থেকে মক্কার কাফের সম্প্রদায়ের সীমাহীন জুলুম নির্যাতন সহ্য করতে থাকেন রাসূল (সা.) ও তার সাথীবর্গ। কাফেরদের নির্যাতন সইতে না পেরে সাহাবিরা রাসূলের (সা.) আদেশে হিজরতের পথ বেছে নেন। তারপরও রাসূলের (সা.) ওপর মক্কার কাফেরদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ হচ্ছিল না। একদিন রাসূলও (সা.) মদিনায় হিজরত করেন। কিন্তু মক্কা ছেড়ে মদিনায় রাসূল (সা.) থেতু হবার পরও তাদের সন্ত্রাসমূলক অপতৎপরতা বন্ধ ছিল না। তাই ১ম হিজরিতে আল্লাহ মুসলমানদের অস্ত্রধারণ করা ও হামলা প্রতিরোধ করার অনুমতি দান করেন। এরই প্রেক্ষিতে ১ম হিজরির মাস থেকেই মদিনার বাইরে নিরাপত্তা টহল জোরদার ও বিভিন্ন ফৌজ প্রেরণ করতেন। এভাবে একবছর পর্যন্ত অব্যহত। অতঃপর দ্বিতীয় হিজরিতে বদর যুদ্ধের প্রাক্কালে জিহাদকে ফরজ করা হয়।

দ্বিতীয় হিজরির ১৩ রমজান রাসূল (সা.) খবর পেলেন আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে কোরাশদের একটি ব্যবয়াসী কাফেলা মদিনার নিকটবর্তী হাওরা নামক স্থান দিয়ে অতিক্রম করবে। এই কাফেলার এক হাজার উট বোঝাই পঞ্চাশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা। এই বিশাল সম্পদ যদি মক্কার কাফেরদের হাতে পৌঁছে তাদের তারা আরো সীমালঙ্গন করবে। মুসলমানদের ওপর অত্যাচারের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেবে। সেই অত্যাসন্ন বিপদ ও মক্কায় মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের প্রতিশোধের কথা চিন্তা করে রাসূল সেই কাফেলাকে আটকে দেয়ার সিন্ধান্ত নিলেন। এদিকে ব্যবসায়ী দলপতি আবু সুফিয়ান এই খবর পেয়ে মক্কায় খবর পাঠায়। মক্কার অলিতে গলিতে আবু জাহেল ছড়িয়ে দেয় মুহাম্মাদ আমাদের ব্যবসায়ী কাফেলায় হামলা করেছে এখনই তাকে প্রতিহত করতে হবে। সেই লক্ষ্যে আবু জাহেলের নেতৃত্ব রণসাজে সজ্জিত ১৩শ সৈন্যের বিশাল বাহিনী রওয়ানা হয়ে যায়। তবে মক্কার বাহিনী পৌঁছার পূর্বেই আবু সুফিয়ান সাগর সীমান্ত দিয়ে নিরাপদ এলাকায় প্রবেশ করেন। তাই তিনি আবু জাহেলকে বলেন আমরা নিরাপদ। বাহিনী নিয়ে মক্কার ফিরো!

এই সংবাদে সবাই মক্কায় ফিরতে রাজি হলেও বেঁকে বসেন আবু জাহেল। সে অহংকার আর দম্ভভরে বলে উঠলো আমরা এখানে তিনদিন থাকবো, আমাদের শক্তি শৌর্যবীর্য প্রকাশ করবো। অতঃপর সতেরই রমজান রোজ শুক্রবার উভয় বাহিনী বদর প্রান্তে এক অসম যুদ্ধে অবতীর্ণ হলো। একপক্ষে অস্ত্রশস্ত্রের অভাব নেই, আরেক পক্ষে অস্ত্রশস্ত্রের নাম গন্ধও নেই। মুসলিম বাহিনীর নিশ্চিত পরাজয় জেনেই মক্কার জাহেলরা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধের জয় পরাজয়ের ফয়সালা তো জমিনে হয় না। হয় আসমানে। মুসলিম বাহিনী সেই আসমানের মালিকের ওপর ভরসা করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুসলিম বাহিনীর বিজয় খবর নিয়ে আকাশ থেকে নেমে আসে ফেরেস্তারা। সেই ঘটনার বিবরণ আল্লাহ নিজেই দিয়েছেন পাক কোরআনে-

وَلَقَدۡ نَصَرَكُمُ ٱللَّهُ بِبَدۡرٖ وَأَنتُمۡ أَذِلَّةٞۖ فَٱتَّقُواْ ٱللَّهَ لَعَلَّكُمۡ تَشۡكُرُونَ
অর্থ : আর অবশ্যই আল্লাহ তোমাদেরকে বদরে সাহায্য করেছেন অথচ তোমরা ছিলে হীনবল। অতএব, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, আশা করা যায়, তোমরা শোকরগুজার হবে। (সূরাতুল আলে ইমরান, আয়াত নম্বর : ১২৩)।

ইসলামের ইতিহাসে বদর যুদ্ধের তাৎপর্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এই যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী পরাজয় বরণ করলে হয়তো পৃথিবীর ইতিহাস থেকে নামনিশানা মুছে যেতো। এই যুদ্ধে আবু জাহেলসহ ৭০ জন জাদরেল কাফের নিহত হয়।

মক্কাবিজয়
মক্কাবিজয় ইসলামের ইতিহাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। যেই ঘটনার মধ্য দিয়ে ইসলাম চির উন্নতের খেতাব পেয়েছে। সেই মক্কাবিজয়টি হয়েছে এই রমজানুল মোবারকে। ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ। ৬ষ্ঠ হিজরির হুদায়বিয়ার সন্ধিতে কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। সেই চুক্তিতে আরবের খুজআ গোত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে মিত্র গড়লো। ওদিকে কোরেশদের সঙ্গে বনু বকর গোত্র মিত্র গড়লো। বনুখুজয়া আর বনুবকরের মাঝে ছিল পুরানো দ্বন্ধ। সন্ধির ফলে কিছু দিনের জন্য সেই অন্যায় জিগাংসা বন্ধ ছিল। কিন্তু বনু বকর সন্ধির সময়কে মহাসুযোগ মনে করে রাতের আঁধারে বনু খুজয়ার ওপর হামলা করলো। এই হামলার ক্ষেত্রে কোরেশরা পর্যাপ্ত পরিমাণ সাহায্য করলো। ইকরিমা ইবনে আবি জাহাল সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া, সুহাইল ইবনে আমর মুখোশ পড়ে বনু বকরের পক্ষে যুদ্ধ করলো। বনু খুজয়া অনন্যোপায় হয়ে হেরেমে আশ্রয় নিলো কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। হেরেমের ভেতরই বনু খুজয়ার লোকদের হত্যা করলো। এই হামলা ও হত্যাকাণ্ড ছিল সন্ধির সম্পূর্ণ বিপরীত। তাই, খুজআ রাসূলের (সা.) কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে।

রাসূল (সা.) তাদেরকে তিনটি শর্ত দিলেন। এই অন্যায় হামলায় মারা গেছে তাদের রক্তপণ দিতে হবে ২. কোরাইশরা বনু বকরের সাহায্য করা থেকে বিরত থাকবে, অথবা ৩. ঘোষণা করে দেয়া হোক যে ‘হুদাইবিয়ার’ সন্ধিচুক্ত ভঙ্গ করা হলো। কোরেশদের পক্ষে কুরতাহ ইবনে ওমর ঘোষণা করলো তৃতীয় শর্তটি মেনে নিলাম। সেই লক্ষ্যে ৮ হিজরির ২০ রমজান হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রায় দশহাজার সৈন্যসহ মক্কার দিকে রওয়ানা হন। পথিমধ্যে আরবের অন্যান্য গোত্রও যোগ দিতে থাকে। বিশাল বাহিনী পরিণত হয় রাসূলুল্লাহ (সা.) এই মক্কাভিযানের কাফেলা। অতঃপর বিনা রক্তপাতে মুসলমানরা মক্কা বিজয় করে। ইসলামের ইতিহাসে এটিই ছিল রক্তপাতহীন মহাবিজয়। যদিও কোরআন হুদায়বিয়ার সন্ধিকে প্রকাশ্য বিজয় বলে ঘোষণা দিয়েছে। মূলত হুদায়বিয়ার বিজয়ের পূর্ণতা ছিল মক্কাবিজয়। মক্কাবিজয়ের মধ্য দিয়ে আরবের অন্যান্যগোত্রগুলো ইসলামের সুশীতল ছায়া তলে আসে। বাইতুল্লাহ থেকে চিরতরে সরিয়ে দেয়া হয় দেবদেবির মূর্তি ও প্রতিমাগুলো।

স্পেনে ইসলামী শাসনের শুভসূচনা
৯১ হিজরির ১ম রমজান আফ্রিকার গভর্নর মুসা বিন নুসাইর নির্দেশে একটি ক্ষুদ্রদল তারিফ বিন মালিকে নেতৃত্বে সিউটা দ্বীপ থেকে জিব্রাল্টার প্রণালী অতিক্রম করে স্পেন লাগোয়া একটি ছোট্ট দ্বীপে পৌঁছে। আজো সেই দ্বীপের নাম তারিফ উপদ্বীপ। তারিফ বিন মালিক অল্পদিনের মধ্যই স্পেন সম্পর্কে জেনে দ্রুত ফিরে আসে। তাদেরকে পাঠানোই হয়েছিল স্পেনের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার জন্য। এই পর্যবেক্ষণ বাহিনী ফিরে আসার পরই মুসা বিন নুসাইর তারিক বিন যিয়াদের নেতৃত্বের একটি বাহিনী প্রেরণ করেন। অতঃপর ৯২ হিজরির ২৮ রমজান জিব্রাল্টার উপদ্বীপে স্পেনের খৃস্টান সম্রাট রডানিকের ১ লক্ষ সৈন্যের এক বিশাল বাহিনীর মোকাবিলায় সিংহের মতো দাঁড়িয়ে যান ২১ বছরের তাগড়া যুবক তারিক বিন যিয়াদ (রহ.)। তিনি মাত্র ১২ হাজার ক্ষুদ্র বাহিনী নিয়ে রাজা রডানিকের বিরুদ্ধে দাঁড়ান। কিন্তু তারেকের ক্ষুদ্রবাহিনী যখন আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে তরবারি উঁচু করলো এমনেই ধরাশয়ী হয়ে গেলো রডানিকের বিশাল বাহিনী। পরাজয়বরণ করলো খৃস্টানবাহিনী। সম্রাট রডানিক পালায়ন করলো। বিজয়ের হাসি হাসলো মুসলিমরা। সময়টা ছিল ৯২ হিজরির ২৮ রমজান। ক্রমান্বয়ে পুরো স্পেনে উড্ডীন হলো কালিমার পতাকা।

তুরের যুদ্ধ
তুরের যুদ্ধ। অনেকের কাছে এই যুদ্ধের কাহিনী অজানা। এই যুদ্ধকে আরবিতে মা’রিকাতি বালাদিশ শুহাদা’ তথা শহিদদের রাজপ্রাসাদ নামে উপস্থাপন করা হয়। হিজরি দ্বিতীয় শতাব্দির প্রথম দিকের কথা। তখন স্পেনে মুসলিম শাসনের যৌবনকাল। ইউরোপের অভ্যন্তরে মুসলমানদের বিজয় অভিযান পুরোধমে এগিয়ে চলছে। কারো সাহস নেই মুসলিম বাহিনীর সামনে বুকটান করে দাঁড়াবে। চতুর্দিকে খৃস্টান বাহিনীর দম্ভচুর্ণ করার শব্দ। এরই এক পর্যায়ে ১১৫ হিজরিতে ফ্রান্সের দক্ষিণে অবস্থিত তুর ও পোয়াতিয়া শহরের কাছে তৎকালীন স্পেনের আমির আবদুর রহমান গাফিকির নেতৃতে মুসলিম বাহিনী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। তুরযুদ্ধে প্রতিপক্ষ ছিলো ইউরোপের খৃস্টানদের সম্মিলিত বাহিনীপ্রধান চার্স মাল্টিল। তুরে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে প্রথমদিকে মুসলিম বাহিনী অসীম বীরত্বে খৃস্টান বাহিনীকে পরাজয় করেন। কিন্তু পেছন দিক থেকে খৃস্টানদের গোপন একটি বাহিনী হঠাৎ করে আক্রমণ করে বসে। এই অতর্কিত হামলায় মুসলিম বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। দিশেহারা হয়ে পড়ে পুরোবাহিনী। ফলে অগণিত মুসলিমসৈন্য শাহাদতবরণ করেন।

সেনাপতি আমির আবদুর রহমান গাফিকির অবস্থা বেগতিক দেখে শাহাদতের তামান্নায় নিজেই তরবারি নিয়ে ঢুকে পড়েন শত্রুবাহিনীর সেনাশিবিরে। হাজার হাজার খৃস্টানকে যুদ্ধের স্বাদ দিয়ে জাহান্নামে পাঠিয়ে দেন। তারপর নিজের শরীরের হাজারো তীর নেজা ও তরবারির আঘাত নিয়ে শাহাদতের অমীয় সুধা পান করে বেহেস্তে চলে যান। নেতৃত্বশূন্য মুসলিম বাহিনী ব্যর্থ মনোরথে স্পেন ফিরে আসে। তুরযুদ্ধে কতজন মুসলিম সৈন্য শাহাদতবরণ করেছিল তার কোনো হিসেব নেই। মুসলিম বাহিনী শাহাদাতের পৃথিবীতে ঢুকে যান। এই কারণেই ইতিহাসবিদরা এই যুদ্ধের নাম দিয়েছে- মা’রিকাতি বালাদিশ শুহাদা’ তথা শহিদদের রাজপ্রাসাদ। ইতিহাসবিদরা লেখে- যদি তুরের যুদ্ধে খৃস্টানবাহিনী পরাজয় বরণ করতো তাহলে ইউরোপ থেকে চিরদিনের জন্য খৃস্টানদের নামনিশানা মুছে যেতো। এরপর বহুবার মুসলিম বাহিনী ফ্রান্স আক্রমণ করলেও তেমন কোনো ফল পায়নি।

ঐতিহাসিক তাবুক যুদ্ধ
নবম হিজরির রজব মাসে তাবুক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। কিন্তু তাবুক যুদ্ধের কিছু ঘটনা সংঘটিত হয় নবম হিজরির রমজান মাসে। (আলফিকহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহু: ৩/১৬২৭)এছাড়া হিজরতের দুই বছর পূর্বে রমজান মাসে উম্মুল মো’মিনীন হজরত খাদিজা (রা.) এবং নবীজি (সা.) এর মেয়ে হজরত রুকাইয়া (রা.) ইন্তেকাল করেন।

হজরত হাসান ইবনে আলী (রা.) তৃতীয় হিজরির রমজান মাসে জন্ম গ্রহণ করেন এবং চতুর্থ হিজরিতে নবীজি (সা.) হজরত যায়নাব বিনতে খুযাইমা (রা.) কে বিয়ে করেন। ১১ হিজরির রমজানে নবীজি (সা.) সবচেয়ে আদরের মেয়ে, জান্নাতী নারীদের সরদারনী, হজরত ফাতিমা (রা.) এবং ৪০ হিজরিতে শেরে খোদা হযরত আলী (রা.) ইন্তেকাল করেন।

আমুরিয়ার যুদ্ধ
একজন মুসলিম বোন চিৎকার করে বলেছিল ইয়া মু’তাসিমাহ! তোমার বোন খৃস্টানদের হাতে লাঞ্ছিত! এই কথা শুনে আব্বাসি খলিফা মু’তাসিম বিল্লাহ স্থির থাকতে পারলেন না। তৎক্ষণাত যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে যুদ্ধে রওয়ানা হন। সেই যুদ্ধকেই আমুরিয়ার যুদ্ধ বলে। সময়কালটা আব্বাসীদের। আব্বাসী খলিফা মু’তাসিম বিল্লার সঙ্গে বিদ্রোহ করে বাবুক খুররাম নাম একটি মুসলিম সেনাপ্রধান। এই বাবুক খুররাম আব্বাসীদের ধূলিস্যতা করে দেয়ার জন্য নোমান সম্রাট নওফিল বিন মিকাইলকে তাগাদা দিতে থাকেন। নওফিল বিন মিকাইল যখন দেখলো বিশ্বাসঘাতক সহযোগী পাওয়া গেছে- তখন সুযোগের সদ্ব্যবহার করলো। নওফিল একলক্ষ সৈন্যের একটি বিশাল বাহিনী নিয়ে মুসলিম ভূণ্ডের বিভিন্ন স্থানে আক্রমণ পরিচালনা করে। এরই এক পর্যায়ের তুরস্কের মালাতিয়া ও সিরিয়ার জিবিত্রা সীমান্তে বর্ণনাহীন রক্তপাত ঘটায়। নওফিলের এই অতর্কিত হামলায় অনেক নিরীহ ও সাধারণ মুসলমান শাহাদতবরণ করে। গোলকিবহীন গোলাবারের মতো শুধু গোল করতেই থাকে। এই সময় শতশত মানুষকে শাহাদাত করে দেয় এবং নারী ও শিশুদের বন্দি করে ইউরোপ নিয়ে যায়।

তাদের অত্যাচারের এতোটাই সীমা ছাড়িয়ে গেল যে, আর সহ্য করার ছিল না। তখনই এক মুসলিম বোন ‘ইয়া মু’তাসিমাহ’! বলে চিৎকার করলো। এই চিৎকারের সংবাদ শুনে খলিফা মু’তাসিম বিল্লাহ সঙ্গে সঙ্গে ওইদিকে মার্চ করলো। কিন্তু খলিফা পৌঁছার পূর্বেই নওফেল বাহিনী ধ্বংসযজ্ঞ শেষ করে পালিয়ে যায়। খলিফা মু’তাসিম বিল্লাহ স্থানীয়দের সান্তনা দেয়। জানতে চান নোমানদের শক্তঘাঁটি কোনটি? জবাবে স্থানীয়রা জানায় আমুরিয়া। আমুরিয়া হলো বর্তমান তুরস্কের আঙ্কারার আপশাশের একটি এলাকা। তৎসময় যা কনস্টেন্টিপলের অধীনস্থ ছিল। অতঃপর খলিফা মু’তাসিম বিল্লাহ তার বিশাল বাহিনী নিয়ে ২২৩ হিজরির ৬ই রমজান মাসে আমুরিয়া আক্রমণ করেন। মুর্হর্তেই খলিফা মু’তাসিম বিল্লাহর বাহিনীর সামনে আমুরিয়ার রাজপ্রাসাদ ধূলিস্যাত হয়ে যায়। আমুরিয়ার জুড়ে ধ্বংসের জোয়ার উঠে। কোনো খৃস্টান সৈন্য সেই আক্রমণ থেকে বাঁচতে পারেনি। খলিফা মুসলিম বোনের প্রতিশোধ তীব্রতায় প্রায় পাগলপারা হয়ে যান। তিনি রাগে ক্ষোভে পুরো আমুরিয়া শহরটিকে জ্বালিয়ে দেন। নোমান সম্রাট নওফেল কোনো মতে পালিয়ে সেই বারের মতো বেঁচে যায়। তখন থেকে আমুরিয়ায় বুকে ইসলামের পতাকা উড্ডীন হয়।

আজকে রমজান আসে, মুসলিম বোনেরা নির্যাতিত হয়। কোনো মু’তাসিম বিল্লাহ নেই। রমজান বিজয়ের মাস। আমাদের শপথ নিতে হবে। আমাদের সিয়াম সাধনার মধ্য দিয়ে আমাদেরকে জয়ের প্রশিক্ষণ নিতে হবে। আল্লাহ আমাদের রমজানকে সেইভাবেই আদায় করার তাওফিক দান করুন আমিন।