রোহিঙ্গারা জড়িয়ে পড়েছে অস্ত্র ও ইয়াবা ব্যবসায়; অপতৎপরতা ঠেকাতে ১৩ সুপারিশ

আতাউর রহমান

কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আশপাশ থেকে প্রায়ই ইয়াবার বাহক রোহিঙ্গারা গ্রেফতার হচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হাতে। রাজধানী ঢাকায় ইয়াবা নিয়ে এসেও গ্রেফতার হয়েছে এরা। তবে কক্সবাজার জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার এক প্রতিবেদন সম্প্রতি আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের রীতিমতো চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘রোহিঙ্গারা ইয়াবার পাশাপাশি মিয়ানমার থেকে গোপনে অবৈধ অস্ত্র এনে সন্ত্রাসীদের কাছে বিক্রি করছে।’ 

এই প্রতিবেদনের আলোকে পুলিশ কর্মকর্তারা মনে করছেন, এক সময় মাদক ব্যবসায়ীরা রোহিঙ্গাদের ইয়াবা বহনে ব্যবহার করলেও বর্তমানে এরা সরাসরি ইয়াবা ব্যবসায় নেমেছে। এরা মিয়ানমার থেকে ইয়াবার সঙ্গে অস্ত্রও আনছে। সেসব অস্ত্র যাচ্ছে সন্ত্রাসীদের কাছে। 

এদিকে বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ডেভেলপমেন্ট কমিটি ও একাধিক রোহিঙ্গা পরিবারের সঙ্গে কথা বলেও জানা গেছে, ইয়াবা এবং অস্ত্র পাচার ও ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে আশ্রয় নেওয়া অনেকে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দায়িত্বরত বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার বিভিন্ন সূত্র সমকালকে জানিয়েছে, ইয়াবা ব্যবসার জের ধরে ক্যাম্পের ভেতর রোহিঙ্গাদের নিজেদের মধ্যেও হানাহানি ঘটছে। পাচার হওয়া অস্ত্র সন্ত্রাসীদের কাছে বিক্রির পাশাপাশি তারা নিজেরাও ব্যবহার করছে এই অস্ত্র।

কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন সমকালকে বলেন, মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের ইয়াবা ও অবৈধ অস্ত্র আনার বিষয়টি তিনি প্রতিবেদন দিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে জানিয়েছেন। কক্সবাজার জেলার নিরাপত্তার জন্য মোটা দাগে চারটি সমস্যাও চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব সমস্যার সমাধানে সম্ভাব্য করণীয় সম্পর্কেও মন্তব্য করা হয়েছে পুলিশ সদর দপ্তরের প্রতিবেদনে। 

পুলিশ সুপার বলেন, বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে অন্তত ৫৪ কিলোমিটার  খোলা সীমান্ত রয়েছে। কাঁটাতারবিহীন এই সীমান্তপথে রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে অবৈধ অস্ত্র ও ইয়াবা এনে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দিচ্ছে।

বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দায়িত্বরত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, গত দুই মাসে কক্সবাজার এলাকা থেকে ইয়াবাসহ অন্তত ৫০ জন রোহিঙ্গাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে র‌্যাব সাতজনকে, পুলিশ ১৩ জনকে, বিজিবি ১৫ জনকে এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সদস্যরা আটজনকে গ্রেফতার করে। সর্বশেষ গত ২০ মে টেকনাফে বিজিবি সদস্যরা তিন রোহিঙ্গা নারীকে ইয়াবাসহ গ্রেফতার করে। 

এদিকে গত এক বছরে ইয়াবা বহন, সেবন ও কেনাবেচার অভিযোগে বিভিন্ন ক্যাম্পের শতাধিক রোহিঙ্গা আটক হয়েছে। এসব ঘটনায় টেকনাফ ও উখিয়া থানায় নিয়মিত মামলা হয়েছে। টেকনাফ ও উখিয়ায় ৩০টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মাদক বিক্রি ও সেবন ও মজুদের জন্য পাঁচ শতাধিক আখড়া গড়ে উঠেছে। এসব এলাকায় অভিযান চালানোও ঝুঁকিপূর্ণ।

পুলিশ প্রতিবেদনে যা বলা হয়েছে :কক্সবাজার জেলা পুলিশের বিশেষ শাখা থেকে ঢাকায় পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠানো প্রতিবেদনে এ অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য চারটি সমস্যাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে- ইয়াবা ব্যবসায় রোহিঙ্গা সংশ্নিষ্টতা, অবৈধ অস্ত্র আনা, অরক্ষিত সীমান্ত এলাকা এবং নৌ বা সমুদ্রপথে ইয়াবা পাচার। 

রোহিঙ্গাদের ইয়াবা ব্যবসা সম্পর্কে এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টেকনাফ ও উখিয়া থানার সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের মংডুর বিভিন্ন এলাকায় ইয়াবা তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত অন্তত সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গা এ দুটি থানার বিভিন্ন পাহাড়ি ও সমতল এলাকায় গড়ে ওঠা ৩০টি ক্যাম্পে বসবাস করছে। ক্যাম্পগুলোতে কোন কাঁটাতারের বেড়াও নেই। রোহিঙ্গারা সরুপথে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে পাশের দেশ মিয়ানমারে গিয়ে ইয়াবা নিয়ে আসছে। পরে তা দেশের মাদক ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে। কক্সবাজারে মাদকবিরোধী কঠোর কার্যক্রম থাকায় স্থানীয়দের মাধ্যমে ইয়াবা পাচার কমলেও রোহিঙ্গারা তা অব্যাহত রেখেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গারা ইয়াবার সঙ্গে অবৈধ অস্ত্র এনে সন্ত্রাসীদের কাছে বিক্রি করছে- এমন তথ্যও মিলেছে। কিছু রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীও ক্যাম্পে নিরীহদের হত্যা, অপহরণ এবং মুক্তিপণ আদায়ের কাজে এসব অস্ত্র ব্যবহার করছে। নিজেদের মধ্যে আধিপত্য ধরে রাখতেও এসব অস্ত্রের ব্যবহার হয়ে আসছে। 

অরক্ষিত সীমান্তের বিষয়ে বলা হয়, এ কারণে প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে রোহিঙ্গা ও সন্ত্রাসী গ্রুপের সদস্যদের অবাধ যাতায়াত রয়েছে। এসব পথে ইয়াবা ও অবৈধ অস্ত্র আসছে। এতে সীমান্ত এলাকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হতে পারে। 

রোহিঙ্গা মাদক ব্যবাসীয়ারা বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন নাফ নদ ও সমুদ্রপথে ইয়াবা এনে দেশের মধ্যে বিক্রি করছে বলে এ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

যা বলছেন রোহিঙ্গা নেতারা :পুলিশের বিশেষ শাখার এ প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু নিয়ে সমকালের পক্ষ থেকে কথা বলা হয় বিভিন্ন ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা ও বাসিন্দাদের সঙ্গে। তাদের অনেকে বলেন, শুরুর দিকে কিছু না বুঝে রোহিঙ্গা নারী ও শিশুরা স্থানীয় মাদক ব্যবসায়ীদের হয়ে ইয়াবা পাচার করত। নিজেদের কাছে মজুদও রাখত। তবে এটি লাভজনক হওয়ায় অর্থাভাবে অনেক রোহিঙ্গা এখন নিজেরাই ইয়াবা এনে বিক্রি করছে।

উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্প উন্নয়ন কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ফয়েজু আরাকানি বলেন, অভাবের তাড়নায় রোহিঙ্গাদের ক্ষুদ্র একটি অংশ মাদক ও অস্ত্র পাচারে জড়িত হয়েছে। 

টেকনাফের লেদা ক্যাম্প উন্নয়ন কমিটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলম বলেন, শুরুর দিকে রোহিঙ্গারা এ ধরনের অবৈধ কাজে ছিল না। হয়ত এ দেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ আগে থেকে এদেশে ইয়াবা পাচার করত। সুযোগ পেয়ে তারা আবারও হয়ত অবৈধ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে। এই রোহিঙ্গা নেতা বলেন, বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে। পুলিশ বিভিন্ন ক্যাম্পে মাদকবিরোধী কর্মসূচি পালন করছে। এভাবে রোহিঙ্গাদের সচেতন করা হচ্ছে। বিষয়টি ইতিবাচক।

টেকনাফ শালবাগান রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চেয়ারম্যান রমিদা বেগম বলেন, অভাব ও অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে স্থানীয় কিছু লোক রোহিঙ্গাদের এই অবৈধ পথে নামিয়েছে।

পুলিশের ১৩ সুপারিশ :রোহিঙ্গাদের একাংশের ইয়াবা ও অবৈধ অস্ত্র ব্যবসা ঠেকাতে পুলিশের গোয়েন্দা প্রতিবেদনে ১৩টি সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে মিয়ানমারের মংডুতে গড়ে ওঠা ইয়াবা কারখানাগুলো যাতে ধ্বংস করা হয়, সেজন্য মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনার সুপারিশও রয়েছে। মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশ যাতে তাদের সীমান্তে কঠোর অবস্থান নেয়, সে ব্যাপারেও আলোচনা করতে বলা হয়েছে। 

দ্বিতীয় সুপারিশে উখিয়া থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ৫৪ কিলোমিটার খোলা সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া ও এর পাশে রাস্তা নির্মাণের কথা বলা হয়েছে- যাতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) কঠোরভাবে টহল দিতে পারে। অন্যান্য সুপারিশগুলোর মধ্যে নাফ নদ ও সমুদ্রপথে যৌথ টহল, মিয়ানমারের সশস্ত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের নামের তালিকা দুই দেশের মধ্যে বিনিময়ের পর তাদের অবস্থান শনাক্ত করে কঠোর অভিযান, স্থানীয় এলাকায় বাংলাদেশি জেলেদের শনাক্ত করে তাদের পরিচয়পত্র দেওয়ার পাশাপাশি মিয়ানমারকেও একই ধরনের অনুরোধ করা ও সীমান্ত এলাকায় যৌথ বাহিনীর আকস্মিক সাঁড়াশি অভিযান চালানোর সুপারিশ করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন বলেন, অনেক সুপারিশ হঠাৎ করেই বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এগুলো ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের ইয়াবা ও অস্ত্র ব্যবসা ঠেকাতে পুলিশ সর্তক রয়েছে।