ইসলামে আশুরা এত গুরুত্বপূর্ণ কেন?

বেলায়েত হুসাইন •

 

ইসলামের পরিভাষায় আরবি মহররম মাসের ১০ তারিখ ‘আশুরা’ নামে পরিচিত। কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনা আশুরা ও মহররম মাসের ইতিহাসে নবচেতনার উন্মেষ ঘটালেও এর তাৎপর্য ইসলামে, এমনকি তারও বহু আগে থেকেই নানাভাবে স্বীকৃত।

পবিত্র কোরআনে মহররম মাসের ফজিলত সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর কাছে মাসের সংখ্যা ১২টি; এর মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত।’ (সুরা তওবা, আয়াত : ৩৬)। আর ওই মাস চারটি হলো— জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও রজব। (তাফসিরে মাজহারি)

হাদিস শরিফে এ মাসকে ‘শাহরুল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর মাস’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। হাদিসে এসেছে— (রমজানের পর) শ্রেষ্ঠ মাস হচ্ছে আল্লাহর মাস, যাকে তোমরা মহররম বলে থাকো। (সুনানে কুবরা, হাদিস : ৪২১৬)

মহররম মাসের ১০ তারিখ তথা আশুরার দিনে রোজা পালনেও ইসলামে বিশেষ ফজিলতের কথা বর্ণিত হয়েছে। বিশুদ্ধ মত অনুসারে– রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে মুসলিমদের ওপর আশুরার রোজা রাখা ওয়াজিব ছিল। কিন্তু রমজানে রোজা ফরজ হওয়ার পর এদিন রোজা রাখা মুস্তাহাব।

এদিন রোজা পালন যে মুস্তাহাব, হজরত আয়েশার (রা.) একটি হাদিসেও তার পক্ষে বর্ণনা এসেছে। তিনি বলেন, ‘(জাহেলি যুগে) লোকেরা রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে আশুরার দিন রোজা রাখতো। এদিন কাবায় গিলাফ জড়ানো হতো। এরপর যখন রমজানের রোজা ফরজ হলো, তখন আল্লাহর রাসুল (সা.) বললেন— যে এদিন রোজা রাখতে চায় সে রাখুক। যে না চায় না রাখুক। (বুখারি শরিফ, হাদিস : ১৫৯২)’

আশুরার রোজায় গোনাহ মাফের ওয়াদা করা হয়েছে। এ রোজার ফজিলত বর্ণনা করে রাসুল (সা.) বলেন, ‘আশুরার রোজার ব্যাপারে আমি আশাবাদী; আল্লাহ তায়ালা এর ওসিলায় অতীতের এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেবেন।’ (তিরমিজি ও মুসনাদে আহমাদ)

আশুরা উপলক্ষে ইসলামে দু’টি রোজার কথা বলা হয়েছে। রাসুল (সা.) ১০ মহররমের সঙ্গে ৯ কিংবা ১১ মহররম মিলিয়ে দুটি রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। ৯ তারিখে রাখা উত্তম। কারণ একটি হাদিসে ৯ তারিখের কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘তোমরা ৯ তারিখ এবং ১০ তারিখ রোজা রাখো…।’ (তিরমিজি শরিফ, হাদিস : ৭৫৫)

১০ মহররম তথা আশুরা মুসলিম ইতিহাসে আরও যেসব কারণে গুরুত্বপূর্ণ। সেগুলোর মধ্য থেকে উল্লেখযোগ্য কিছু কারণ তুলে ধরা হলো–

১. মহান আল্লাহ এদিনই আসমান-জমিন, কলম ও হজরত আদমকে (আ.) সৃষ্টি করেন।
২. এদিনই আল্লাহতায়ালা তার নবী হজরত আদমের (আ.) তওবা কবুল করেন।
৩. আশুরার দিনই হজরত ইদরিসকে (আ.) আসমানে উঠিয়ে নেওয়া হয়।
৪. এদিনই আল্লাহতায়ালা তার নবী হজরত নুহের (আ.) কিশতিকে ভয়ঙ্কর বন্যা থেকে রক্ষা করেন।
৫. পবিত্র এই দিনে হজরত ইবরাহিম (আ.) ‘খলিলুল্লাহ’ উপাধিতে ভূষিত হন।
৬. এদিনই হজরত ইসমাইল (আ.) জন্মগ্রহণ করেন।
৭. আশুরার দিনই হজরত ইউসুফ (আ.) কারাগার থেকে মুক্তি পান এবং মিসরের শাসক নিযুক্ত হন।
৮. পবিত্র এ দিনটিতেই হজরত ইউসুফ (আ.) দীর্ঘ দিন পর তার বাবা হজরত ইয়াকুবের (আ.) সঙ্গে মিলিত হন।
৯. এদিন হজরত মুসা (আ.)-এর নেতৃত্বে বনী ইসরাইল ফিরআউনের জুলুম থেকে মুক্তি লাভ করে।
১০. এ দিনটিতেই হজরত মুসার (আ.) ওপর পবিত্র তাওরাত নাজিল হয়।
১১. আশুরার দিনে হজরত সোলাইমান (আ.) তার বাদশাহী ফিরে পান।
১২. এদিনই হজরত আইয়ুব (আ.) জটিল রোগ থেকে মুক্তি লাভ করেন।
১৩. এদিনই হজরত ইউনুস (আ.) দীর্ঘ ৪০ দিন মাছের পেটে থাকার পর আল্লাহর অনুগ্রহে বের হন।
১৪. এ দিনটিতেই হজরত ইউনুসের (আ.) উম্মতের তওবা কবুল করা হয়।
১৫. হজরত ঈসা (আ.) এদিনই জন্মগ্রহণ করেন এবং এদিনই ইহুদিদের ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করে আল্লাহ তাকে আসমানে উঠিয়ে নেন।
১৬. আশুরার দিনেই পৃথিবীতে সর্বপ্রথম বৃষ্টি হয়।
১৭. এদিনই মক্কার কোরাইশরা পবিত্র কাবাঘরে নতুন গিলাফ জড়ায়।
১৮. পবিত্র আশুরার দিনেই মহানবীর (সা.) সঙ্গে হজরত খাদিজার (রা.) বিয়ে সম্পন্ন হয়।
১৯. এই দিনেই রাসুলের (সা.) দৌহিত্র হজরত হুসাইন (রা.) কুফায় শাহাদাৎ বরণ করেন।
২০. এবং আশুরার দিনেই কেয়ামত তথা মহাপ্রলয় অনুষ্ঠিত হবে। (মাআরেফুল কোরআন ও দেওবন্দের ওয়েবসাইট)

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী, শিক্ষক, মারকাযুদ দিরাসাহ আল ইসলামিয়্যাহ, ঢাকা