কে এই শামীমা নূর পাপিয়া?

যুব মহিলা লীগের পদ বাগিয়ে অভিজাত এলাকায় জমজমাট নারী ব্যবসাসহ ভয়ঙ্কর সব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন নরসিংদী জেলার কথিত নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউ। মাত্র ৩০ বছরেরও কম বয়সের মধ্যেই বিশাল অর্থ বিত্তের মালিক বনে গেছেন এই নারী।

আলোচিত এই নারী নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সদ্য বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক। তিনি নিজেকে কেন্দ্রীয় নেত্রী হিসেবেও পরিচয় দিতেন। এই পরিচয়ের আড়ালে ছিল তার অপরাধমূলক কাজকর্ম। রাজনৈতিক কর্মসূচিতে গিয়ে নেতাদের ফুল দিয়ে ছবি তুলে সেই ছবিও অপব্যবহার করতেন।
পাপিয়ার সব কর্মকাণ্ডের অন্যতম অংশীদার তার স্বামী মফিজুর রহমান চৌধুরী সুমন। এক সময় নরসিংদী শহর ছাত্রলীগের আহ্বায়ক ছিলেন সুমন। পরে ছিলেন নরসিংদীর প্রয়াত পৌর মেয়র লোকমানের বডিগার্ড।

নরসিংদী শহরের ব্রাক্ষন্দী মহল্লার মতিউর রহমানের ছেলে মফিজুর রহমান চৌধুরী সুমন। নরসিংদী শহর ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক সুমন। প্রয়াত মেয়র লোকমান হোসেনের হাত ধরে রাজনীতিতে নামে সে। শৈশব থেকেই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন সুমন। ২০০১ সালে পৌরসভার কমিশনার মানিক মিয়াকে যাত্রা প্যান্ডেলে গিয়ে হত্যার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ওই হত্যাকাণ্ডের এজহারভুক্ত আসামি সুমন ওরফে মতি সুমন। হত্যাকাণ্ড ও সন্ত্রাস কর্মকাণ্ডের ওপর ভর করে তার উত্থান। ২০০৯ সালে প্রেমের সম্পর্কে পর পাপিয়া চৌধুরীকে বিয়ে করেন সুমন।

সুমনকে বিয়ের পর পাপিয়া রাজনীতিতে পুরোপুরি জড়িয়ে পড়েন। লোকমান হত্যাকাণ্ডের বছর তিনেক পর পাপিয়া চৌধুরীর ওপর সন্ত্রাসী হামলা হয়। ওই সময় পাপিয়াকে গুলি করে সন্ত্রাসীরা। এরপর তারা নরসিংদী ছেড়ে ঢাকায় পাড়ি জমান। ঢাকায় এক নারী এমপির সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে তাদের। এরপর থেকে পাপিয়া চৌধুরী ও তার স্বামী সুমন ওরফে মতি সুমন রাজধানীর সাবেক এক সংরক্ষিত আসনের এমপির আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। ওই এমপির সঙ্গে তার গাড়ির ব্যবসা আছে বলেও জানা গেছে।
২০১৮ সালে নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক হয় পাপিয়া।

নরসিংদী জেলা শহরের ভাগদী মারকাজ মসজিদ এলাকায় পাপিয়ার বাবা সাইফুল বারীর বাসা। সেখানে গিয়ে দেখা যায় একটি দোতালা পাকা বাড়ি তার বাবার। তার শ্বশুরবাড়ি ব্রাহ্মণদীতে চারতলা একটি বাড়ি আছে। রাজধানীর ফার্মগেট ইন্দিরা রোডে ‘রওশন ডমিনো রিলিভো’ বিলাসবহুল ভবনে তার ও তার স্বামীর নামে দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে। এ ছাড়া তার কালো ও সাদা রঙের দুটি হায়েস মাইক্রোবাস, একটি হ্যারিয়ার, একটি নোয়া ও একটি ভিজেল কার আছে। তার স্বামীর মালিকানায় থাইল্যান্ডে একটি বারও আছে বলে জানা গেছে। রাজধানীর এফডিসি গেটের সঙ্গে ‘কার এক্সচেঞ্জ’ নামে তার একটি গাড়ির শোরুম আছে বলে জানা গেছে।

নরসিংদীর শহরের ভাগদী এলাকায় কেএমসি কার ওয়াশ নামে একটি গাড়ির সার্ভিস সেন্টার রয়েছে তার স্বামী সুমনের। নরসিংদীতে রয়েছে সুমন ও তার স্ত্রী পাপিয়ার বিশাল কর্মীবাহিনী। মাঝেমধ্যেই তারা বিশাল শোডাউন দেন আওয়ামী লীগের মিছিল-মিটিংয়ে। পাপিয়ার স্বামী সুমন ঢাকায় সন্ত্রাসের পাশাপাশি অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গেও সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে।

পাঁচ তারকা হোটেলে নারী ও মাদক ব্যবসাই পাপিয়া ও তার স্বামীর আয়ের মূল উৎস। দেশের অভিজাত কিছু মানুষ ও বিদেশিরাই এর গ্রাহক। ইন্টারনেটে স্কট সার্ভিস খুলে বসে খদ্দেরদের কাছে তাদের চাহিদামতো সুন্দরী তরুণী পাঠাতেন। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে শিক্ষিত সুন্দরী তরুণীদের সংগ্রহ করতেন। একপর্যায়ে তাদেরকে ধণাঢ্য ব্যক্তিদের শয্যাসঙ্গী করতেন পাপিয়া। এ জন্য একাধিক অভিজাত হোটেলের রুম ভাড়া নিত নামে-বেনামে।

র‍্যাব জানায়, রাজধানীর গুলশানের হোটেল ওয়েস্টিনে প্রেসিডেন্ট স্যুট নিজের নামে সব সময় বুকড করে নানা ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছিলেন পাপিয়া। যিনি হোটেলটির বারে বিলবাবদ প্রতিদিন পরিশোধ করতেন প্রায় আড়াই লাখ টাকা।

বৈধ আয় অনুযায়ী পাপিয়ার বাৎসরিক আয় মাত্র ১৯ লাখ টাকা। অথচ হোটেল ওয়েস্টিনে শুধু গত তিন মাসেই বিল পরিশোধ করেছেন প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। যিনি নারী সংক্রান্ত অপকর্ম ছাড়াও অস্ত্র-মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি ও বিভিন্ন তদবির বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত।

সুনির্দিষ্ট কোনো পেশা নেই, তবুও স্বল্প সময়ে বিপুল সম্পত্তি ও অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক শামীমা নূর পাপিয়া। রাজধানীর ফার্মগেটের ২৮ ইন্দিরা রোডে দুটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ও ব্যক্তিগত গাড়ি, নরসিংদী শহরে দুটি ফ্ল্যাট এবং বাগদী এলাকায় দুই কোটি টাকা মূল্যের দুটি প্লটও রয়েছে তার।

তাদের আয়ের আরেকটি উৎস হচ্ছে নারীদের দিয়ে জোরপূর্বক অনৈতিক কাজ করানো। তারা ঢাকার বিভিন্ন বিলাসবহুল হোটেলে অবস্থান করে কম বয়সী মেয়েদের দিয়ে জোরপূর্বক অনৈতিক কাজে বাধ্য করান। যাদের অধিকাংশই নরসিংদী এলাকা থেকে চাকরি দেয়ার কথা বলে এবং বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে আসা হয়। এসব অনৈতিক কাজে কেউ অস্বীকৃতি জানালে তাদের বিভিন্নভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হতো। ভুক্তভোগীরা এ ব্যাপারে মুখ খুলতেও ভয় পাচ্ছেন। পাপিয়ার জব্দ মোবাইল ফোন থেকে অশ্লীল ভিডিও মিলেছে।

জানা গেছে, প্রায় সব পাঁচ তারকা হোটেলেই ছিল পাপিয়ার এসকর্ট ব্যবসা। পাঁচ তারকা হোটেলে নারী ও মাদক ব্যবসাই তার আয়ের মূল উৎস। দেশের অভিজাত কিছু মানুষ ও বিদেশিরাই এর গ্রাহক। ইন্টারনেটে স্কট সার্ভিস খুলে বসে খদ্দেরদের কাছে তাদের চাহিদামতো সুন্দরী তরুণী পাঠাতেন। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে শিক্ষিত সুন্দরী তরুণীদের সংগ্রহ করতেন। একপর্যায়ে তাদেরকে ধনাঢ্য ব্যক্তিদের শয্যাসঙ্গী হতে বাধ্য করতেন পাপিয়া। এরই মধ্যে পাপিয়ার কাছ থেকে গোপন ক্যামেরায় ধারণকৃত অনেক ধনাঢ্য ও প্রভাবশালী ব্যক্তির অন্তরঙ্গ দৃশ্যের ভিডিও ক্লিপ উদ্ধার করেছেন র‌্যাব কর্মকর্তারা। গোপন ক্যামেরায় মেয়েদের ছবি ধারণ করে তাদের নিয়মিতভাবে ব্ল্যাকমেইল করতেন তিনি। পাপিয়ার কাছ থেকে উদ্ধারকৃত একটি ভিডিও ক্লিপে দেখা যায়- পাপিয়া বসে আছেন বাইজিবাড়ির সর্দারনির মতো। তার হাতে মোটা একটি বেতের লাঠি। তার কব্জায় থাকা মেয়েরা কথা না শুনলে পেটাতেন। পাপিয়া একাধিক অভিজাত হোটেলের রুম ভাড়া নিতেন নামে-বেনামে। সর্বশেষ গতকাল পর্যন্ত একটি হোটেলের প্রেসিডেনশিয়াল স্যুটে তার নামে পাওয়া গেছে। এই পাঁচ তারকা হোটেলে বিভিন্ন মেয়েকে পাপিয়া নিজেই নিয়ে যেতেন। তাদেরকে দিয়ে করাতেন অবৈধ দেহব্যবসা। এরই মধ্যে জিজ্ঞাসাবাদে সবকিছুই কবুল করেছেন পাপিয়া।

পাপিয়া ও তার স্বামী সুমন চৌধুরী নরসিংদী এলাকায় ‘কিউ অ্যান্ড সি’ নামের একটি ক্যাডার বাহিনী পরিচালনা করতেন। যাদের মাধ্যমে তারা নরসিংদীর বিভিন্ন এলাকায় চাঁদাবাজি, মাসোহারা আদায়, অস্ত্র ও মাদক ব্যবসাসহ এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে আসছিলেন। তাদের এই ক্যাডার বাহিনীর অনেকের নাম ইতোমধ্যে জানা গেছে, যাদের গ্রেপ্তারে র‌্যাবের অভিযান অব্যাহত আছে।

র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল শাফী উল্লাহ বুলবুল জানান, পাপিয়ার অবৈধ সম্পদের উৎস নিয়ে সিআইডি কাজ করবে। ইতোমধ্যে সিআইডির সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। পাপিয়া ও তার স্বামী সুমনসহ গ্রেফতার চারজনের বিরুদ্ধে জাল মুদ্রা রাখা, অনুমোদন ছাড়া অর্থপাচার, অস্ত্র আইনে মামলা হচ্ছে। এছাড়া আয়ের সঙ্গতিবিহীন অর্থ উপার্জন ও ব্যয়ে মানি লন্ডারিং এবং মাদক আইনেও মামলা প্রক্রিয়াধীন। তাদের সঙ্গে যাদেরই জড়িত থাকার তথ্য-প্রমাণ মিলবে তাদের বিরুদ্ধেই আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

শনিবার সকালে স্বামী মফিজুর রহমান চৌধুরী সুমন, সাবিক্ষর খন্দকার (২৯), শেখ তায়্যিবা (২২) সহ আরও দুজন বিদেশে যাওয়ার সময় বিমানবন্দর এলাকা থেকে তাকে আটক করে র‌্যাব।