রোহিঙ্গাদের হাতে ১০ শতাংশ, বাকিটা বাংলাদেশীদের

তিন বছরে কক্সবাজারে ২৪.৩৩ শতাংশ বন উজাড়

সামরিক জান্তার নিপীড়ন থেকে বাঁচতে ২০১৭ সালে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য কক্সবাজারে বনভূমির একটি অংশে অস্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়। জীবিকা ও জ্বালানির প্রয়োজনেও বনভূমি উজাড় করেছে রোহিঙ্গারা।

গবেষণার তথ্য বলছে, ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত জেলাটিতে উজাড় হয়েছে প্রায় ১৩ হাজার হেক্টর বনভূমি। এর মধ্যে রোহিঙ্গাদের হাতে ধ্বংস হয়েছে মাত্র ১০ শতাংশ। উজাড় হওয়া বনের বাকি ৯০ শতাংশই বাংলাদেশীদের মাধ্যমে হয়েছে বলে বিশ্বব্যাংকের ওই গবেষণায় উঠে এসেছে।

‘রোহিঙ্গা রিফিউজি ক্যাম্প অ্যান্ড ফরেস্ট লস ইন কক্সবাজার, বাংলাদেশ’ শীর্ষক বিশ্বব্যাংকের গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে ফেব্রুয়ারিতে। প্রতিবেদনে বলা হয়, গত তিন দশকে কক্সবাজারে বনভূমি উজাড়ের পরিমাণ বেড়েই চলছে। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গারা বসতি গড়ার পর আরো বড় আকারে বনভূমি উজাড় হতে থাকে। কক্সবাজারের মোট ভূমির মধ্যে বনের পরিমাণ ৫২ হাজার ৬২৯ হেক্টর। স্যাটেলাইট ইমেজ ও রিমোট সেনসিং ডাটা ব্যবহার করে দেখা যায়, ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত তিন বছরে ১২ হাজার ৮০৭ হেক্টর বনভূমি উজাড় হয়। গবেষণায় দেখা যায়, রোহিঙ্গাদের কারণে বনভূমি উজাড় হয়েছে ১ হাজার ৩৩৭ হেক্টর। এর মানে দাঁড়াচ্ছে বাকি ১১ হাজার ৪৭০ হেক্টর বনভূমিই উজাড় হয়েছে স্থানীয়দের মাধ্যমে।

২০১৭ সালে ৭ লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীর জন্য যে ক্যাম্প করা হয় তার এক থেকে পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে বনভূমি উজাড়ের চিত্র উল্লেখ করে গবেষকরা বলেন, আমরা দেখেছি, শরণার্থী শিবিরের এক থেকে পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে ২ হাজার ৬০০ হেক্টর বনভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর বাইরে আরো ৭ হাজার ৭০০ হেক্টর বনভূমি উজাড় হয়। কিন্তু এতে রোহিঙ্গাদের কোনো হাত নেই। গবেষকদের দাবি, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাইরে ক্রমেই স্থানীয়রা এসে বসতি গড়তে থাকে। ফলে এদের হাতেই এক-তৃতীয়াংশ বনভূমি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের বসতি গড়ার আগে বনভূমি উজাড়ের চিত্র উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা বলেন, ১৯৮৯ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত দুই দশকে কক্সবাজারের টেকনাফ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এলাকা ৩ হাজার ৩০৪ হেক্টর থেকে ১ হাজার ৭৯৪ হেক্টরে নেমে এসেছে। গবেষকদের দাবি, এ সময় ব্যাপকভাবে বনভূমি ধ্বংসের পাশাপাশি বন্যপ্রাণী এবং সার্বিকভাবে কক্সবাজারের জীববৈচিত্র্যও হুমকির মুখে পড়ে।

ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) সাবেক কর্মসূচি সমন্বয়ক ও বিশ্বব্যাংকের পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ইসতিয়াক সোবহান বণিক বার্তাকে বলেন, যেভাবে বনাঞ্চল উজাড় হচ্ছে, তাতে বনভূমি হিসেবে রাখা দুষ্কর হবে। বেসরকারি খাতের পাশাপাশি সরকারিভাবেও দখলের প্রতিযোগিতা হচ্ছে। আবার যারা দখল করছে তাদের ঠেকানোর মতো দক্ষতা বা ক্ষমতা বন বিভাগের নেই। ফলে উজাড় হচ্ছে বনাঞ্চল, ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য।

রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে বনভূমি উজাড় হয়েছে এ অভিযোগের বড় একটি ভিত্তি হিসেবে বলা হয়, রোহিঙ্গারা জ্বালানি হিসেবে ব্যাপক গাছ ব্যবহার করে। প্রাথমিকভাবে এটির সত্যতা পাওয়া গেলেও পরবর্তী সময়ে তা অনেকটাই কমে আসে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুরুতে প্রতিটি রোহিঙ্গা পরিবারের জন্য দৈনিক গড়ে পাঁচ কেজি জ্বালানি কাঠের দরকার হতো। এ হিসেবে প্রতিদিন ৮০০ থেকে ৮৫০ টন জ্বালানি কাঠের প্রয়োজন হচ্ছে। যেটা সম্পূর্ণ আশপাশের বন থেকে সংগ্রহ করছে তারা। এমনকি জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করতে গিয়ে তারা পুরো গাছই উপড়ে ফেলেছে। এতে করে ব্যাপকহারে বনভূমি ধ্বংস হয়েছে। বনভূমি দখল অব্যাহত থাকার কারণে ভয়ানক পরিবেশগত ঝুঁকির মুখে পড়ে এলাকাটি। সে সময় প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি বড় ধরনের ক্ষতি ঠেকাতে রোহিঙ্গাদের জ্বালানি হিসেবে কয়লা সরবরাহের কথাও ভাবা হয়েছিল।

পরবর্তী সময়ে রোহিঙ্গা শিবিরে জ্বালানি হিসেবে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) সরবরাহ করা হয়। ধীরে ধীরে জ্বালানি হিসেবে কাঠের ব্যবহার কমিয়ে আনা হয়। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, রোহিঙ্গা ও স্থানীয়রা কক্সবাজারের প্রাকৃতিক পরিবেশকে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বাঁশ কেটে। সেখানে বসতিসহ প্রায় সব ধরনের আসবাবপত্র বাঁশের তৈরি। এতে করে ওই অঞ্চলে ব্যাপক আকারে বাঁশ ধ্বংস করা হয়েছে। বাণিজ্যিকভাবে বাঁশ উৎপাদনের মাধ্যমে এ সংকট কাটানো সম্ভব বলে মনে করছেন গবেষকরা।

যদিও সরকারি কর্মকর্তারা কক্সবাজারে বনভূমি ধ্বংস হওয়া নিয়ে বিশ্বব্যাংকের পর্যবেক্ষণের সঙ্গে একমত নন। তাদের মতে, প্রায় ১৩ হাজার হেক্টর বনাঞ্চল নষ্ট হওয়ার তথ্য সঠিক নয়। তবে যতটুকু নষ্ট হয়েছে, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তা মূলত রোহিঙ্গাদের কারণেই। রোহিঙ্গাদের দেয়া হয়েছে ৬ হাজার ৪২৪ একরের মতো ভূমি। শুরুতে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় গোটা বনাঞ্চল নষ্ট হয়েছে তাদের জন্য। এখন তারকাঁটা দিয়ে সীমানা নির্ধারণসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তত্ত্বাবধানে রাখা হয়েছে তাদের। প্রাথমিকভাবে রোহিঙ্গাদের বিচরণের ক্ষেত্র ছিল ৩০ হাজার একরজুড়ে।

কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. সারওয়ার আলম বণিক বার্তাকে বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে রোহিঙ্গারা বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ছিল। গোটা বনাঞ্চল উজাড় হয়েছে তাদের কারণে। তারা বন সম্পদ ব্যবহার করে খুঁটি বানিয়েছে, ঘর বানিয়েছে। বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেছে। এখন এলপিজির ব্যবস্থা হলেও রোহিঙ্গাদের জ্বালানি প্রয়োজনে অনেক বন নষ্ট হয়েছে। তাদের জন্য সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলো কাজ করছে, সড়ক হচ্ছে। এসব কারণেও ব্যবহার করতে হয়েছে বনের একটি অংশ। দখলের যে ঘটনা ঘটছে সেগুলো খুবই কম, যা শনাক্ত হলে আমরা যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করছি।

সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রতিদিনই বনভূমি দখল হয়ে যাচ্ছে। ব্যক্তি পর্যায়ে যেমন বনভূমি দখল হচ্ছে, তেমনি সরকারি পর্যায়েও বনভূমি বেহাত হয়ে যাচ্ছে। গত তিন মাসে কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগ ও উত্তর বন বিভাগে আনুমানিক ২০০ একর বনভূমি দখল হয়ে গেছে। দখলকৃত বনভূমিতে চাষাবাদ, ঘরবাড়ি, খামারবাড়ি তৈরি করছে দখলদাররা। এমনকি একশ্রেণীর দখলদার প্লট আকারে বনভূমি বিক্রি করছে। কক্সবাজার শহরের আশপাশের এলাকা, মেরিন ড্রাইভ সংলগ্ন এলাকা, জোয়ারিয়ানালা ও সড়কের আশপাশের এলাকায় বনভূমি দখলের হার সবচেয়ে বেশি। এসব এলাকায় অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ অব্যাহত রয়েছে।

অপরদিকে সরকারিভাবে ঘর দিতে পুর্নবাসনের জন্য পাহাড় কেটে সংরক্ষিত বনভূমি দখলের হিড়িক পড়েছে কক্সবাজারে। কক্সবাজারের চকরিয়া, রামু, উখিয়া ও কক্সবাজার সদরে সংরক্ষিত বনভূমিতে এসব ঘর নির্মিত হচ্ছে। সরকারিভাবে ঘর নির্মাণে বিস্তীর্ণ বন উজাড়ের ঘটনাও রয়েছে কক্সবাজারে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বণিক বার্তাকে বলেন, কক্সবাজারে সরকার অবৈধ দখলদারদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে পারছে না। সংরক্ষিত বন হলে সেটা থাকে বন বিভাগের নামে। আর যেটা প্রটেকটেড, তা থাকে জেলা প্রশাসকের নামে। জেলা প্রশাসক সেটা খাস হিসেবে বন্দোবস্ত দিয়ে দেয়। ভালুকাতেও প্রায় ২১ হাজার একর জমির এ অবস্থা হয়েছে। বন বিভাগের দুর্নীতির কারণে বহু বন বেদখল হয়েছে। প্রচুর বসতি হয়ে গেছে। বসবাসকারী যারা থাকেন তাদের সঙ্গে বন বিভাগ সব সময় একটা দ্বন্দ্বে থাকে, তা জিইয়েও রাখে। এতে করে বনের কাঠগুলো কাটতে সুবিধা হয়।

বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, কক্সবাজারের উত্তর বন বিভাগের পিএম খালী রেঞ্জে ১ হাজার ১৩০ জনের দখলে রয়েছে ৮৫২ একর, ঈদগাঁওয়ে ৩৪৪ জনের দখলে ৫৯ দশমিক ৮৮ একর, মেহেরঘোনায় ১ হাজার ৩১৭ জনের দখলে ৬৫৯ দশমিক ১৬ একর, বাঘখালীতে ১ হাজার ৭৬৩ জনের দখলে ৬০৭ দশমিক ৩০ একর, ঈদগড়ে ৭১৩ জনের দখলে ৭৪৬ দশমিক ৮৫ একর, জোয়ারিয়ানালায় ৩৮০ জনের দখলে ২৪৩ দশমিক ৬৭ একর, ফাসিয়াখালীতে ১ হাজার ৯৪৮ জনের দখলে ৫৫৪ দশমিক ৮১ একর ও ফুলছড়িতে ২ হাজার ১২৯ জনের দখলে ৪১৯ দশমিক ৪৭ একর। কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের কক্সবাজার রেঞ্জে ২ হাজার ৪৬৯ জনের দখলে ৮৬৪ দশমিক ৯৩, ধোয়াপালংয়ে ১ হাজার ৯৯৭ জনের দখলে ৬৮০ দশমিক ২১ একর, টেকনাফ রেঞ্জে ১ হাজার ৩৯৯ জনের দখলে ৪৯৯ দশমিক ৯৩ একর, হোয়াইনক্ষ্যইয়ের ১ হাজার ৪২৭ জনের দখলে ১ হাজার ৯৭ দশমিক শূন্য ৫ একর, শীলখালীতে ২ হাজার ৫৬ জনের দখলে ১ হাজার ৩৯১ একর, উখিয়ায় ৪ হাজার ৬৭৫ জনের দখলে ২ হাজার ৬২৬ দশমিক ৬৩ একর, রাজারকুলে ২ হাজার ৮৪৩ জনের দখলে ২ হাজার ১৩৫ দশমিক ৫৪ একর, পানেরছড়ায় ১ হাজার ৪০৯ জনের দখলে ৩৪৩ দশমিক ৭৫ একর এবং ইনানীতে ১ হাজার ৬২১ জনের দখলে ৭ হাজার ৭৮৩ দশমিক ৫১ একর।

পরিবেশবিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এনভায়রনমেন্ট পিপলের প্রধান নির্বাহী রাশেদুল মজিদ বলেন, বনভূমিতে দিনদিন যেভাবে অবৈধ দখলদার বাড়ছে, তাতে অচিরেই বনভূমি বলতে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। শুধু ব্যক্তি পর্যায়ে দখলই নয়, সরকারি পর্যায়েও আমরা বনভূমির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প ও পুনর্বাসনের জন্য শত শত একর সংরক্ষিত বনভূমি ব্যবহার করা হচ্ছে। যেকোনো কাজে বনভূমির ওপর এ আঘাত থেকে সরকারকে সরে আসতে হবে।

সূত্র: বণিকবার্তা