ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন মাদক কারবারির তালিকা

শাহরিয়ার হাসান •

মাদক কারবারি ও পৃষ্ঠপোষকদের তালিকার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে স্বয়ং জাতীয় মাদকবিরোধী কমিটি। তাদের অভিযোগ, আলাদা আলাদা তালিকা করতে গিয়ে আসল কারবারিকে শনাক্ত করা যাচ্ছে না। সেইসঙ্গে তথ্যের ভুলে সাধারণ মানুষের নামও কারবারিদের তালিকায় ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

কমিটির সদস্যদের ধারণা, আইন প্রয়োগকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জাতীয় মাদকবিরোধী কমিটির চতুর্থ সভায় গুরুত্বসহকারে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

সভার সভাপতিত্ব করেন সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব মো. আব্দুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরী। উপস্থিত ছিলেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থারগুলোর প্রধান এবং প্রতিনিধিরা। ৯ জানুয়ারি স্বাক্ষরিত সেই সভার কার্যবিবরণী এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে।

সম্প্রতি কক্সবাজারে ইয়াবা কারবারিদের নতুন একটি তালিকা নিয়ে বেশ হুলস্থুল পড়েছে। সিল-ছাপ্পড়হীন ২৫৫ জনের সেই তালিকা এখন জেলার একটি মহলের সবার ফোনে ফোনে। তালিকায় নতুন নতুন কিছু নামও দেখা গেছে। পুরোনো অনেক কারবারিকে আবার বাদও দেওয়া হয়েছে। রাখা হয়নি আত্মসমর্পণ করে রাষ্ট্রের কাছে ক্ষমা পাওয়া কোনো কারবারিদের। যদিও তাদের অনেকে এখনো ইয়াবা কারবার করছে। শুধু এই তালিকা নয়। জেলায় অন্তত আরও চারটি বাহিনী, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও তিনটি গোয়েন্দা সংস্থার কাছেও এমন একটি করে তালিকা রয়েছে। কোনো তালিকায় কাউকে বড় মাদক কারবারি বলা হচ্ছে, আবার অন্য সংস্থার তালিকাতে রাখাই হচ্ছে না তাকে। অনেকে আবার অভিযোগ করেন, ভয় দেখিয়ে নাম ঢোকানোরও; কিন্তু কোনো বাহিনীর কাছেই নেই পৃষ্ঠপোষকদের নাম।

কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম অবশ্য কালবেলাকে বলেছেন, তার জেলায় অন্য ইউনিটের সঙ্গে মাদক কারবারিদের তালিকা বা অভিযানগত দিক থেকে সমন্বয়ের কোনো ঘাটতি নেই।

এটা শুধু কক্সবাজার জেলায় না। সারা দেশেই বিভিন্ন জেলায় মাদক কারবারিদের এমন তালিকা রয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল আশ্বস্ত করে বলেছেন, তালিকায় নাম এলেই কেউ দোষী হয়ে যাবে না। বাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত করেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

প্রশ্ন উঠছে তবুও কেন এই বিশৃঙ্খলা? সমাধানই বা কী? আলোচনা হয় ওই জাতীয় মাদকবিরোধী কমিটির সভায়। সভায় সভাপতি ও সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব আব্দুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরী বলেন, ‘সব সংস্থার তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ীদের একটি সমন্বিত তালিকা বা ডাটাবেজ তৈরি করতে হবে। এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পাশাপাশি বাংলাদেশ পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, কোস্টগার্ডসহ সব আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।’

এর পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি, র‌্যাবের সহকারী পরিচালক জানান, তাদেরও আলাদা তালিকা রয়েছে, যা তারা নিয়মিত হালনাগাদ করেন; কিন্তু সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব সবার কার্যক্রমের মধ্যে আবারও সমন্বয়ের বিষয়টি গুরুত্ব দেন।

বাংলাদেশ পুলিশের মুখপাত্র মনজুর হোসেন বলেন, তালিকা প্রণয়ন ও অভিযান একেক ইউনিট তাদের নিজেদের মতো করে থাকে। এতে সমন্বয়হীনতা থাকলে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

ওই সভায় বলা হয়, কুরিয়ার সার্ভিস ও অনলাইন ব্যবহার করে মাদকদ্রব্যের হোম ডেলিভারি সার্ভিস বিষয়টির ওপর নাজরদারি বাড়ানোর প্রয়োজন। সঙ্গে নিতে হবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা। এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আব্দুল ওয়াহাব জানান, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ডাক এবং কুরিয়ার সার্ভিসসমূহের কর্তৃপক্ষকে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, মেইলিং অপারেটর ও কুরিয়ার সার্ভিস লাইসেন্স কর্তৃপক্ষ মাদক পাচার রোধে একত্রে কাজ করছে।

সভায় একটি গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালক বলেন, এর বাইরেও দেশে মাদকাসক্তদের প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয়, বয়স-শ্রেণি-পেশার ভিত্তিতে মাদকাসক্তদের পরিসংখ্যান উপস্থাপন-সংক্রান্ত গবেষণা করা প্রয়োজন। পুলিশের বিশেষ শাখার ডিআইজি বলেন, আসলেই এ বিষয়ে একটি বেসলাইন সার্ভে করার দরকার। কোন জেলায় কতজন মাদকাসক্ত আছেন এবং মাদকের প্রকার বিবেচনায় গবেষণা করতে হবে।

পৃষ্ঠপোষকদের নাম মুখে নেন না কেউ : নিয়ম অনুসারে প্রতি তিন মাস পরপর মাদক কারবারিদের তালিকা হালনাগাদ হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত মাদক ব্যবসার পৃষ্ঠপোষক বা গডফাদারদের কোনো তালিকা হয়নি। হয়নি কোথাও মামলাও। কখনো জানাও যায়নি হাজার হাজার কোটি টাকার এই কারবারিতে মূল নেতৃত্ব দিচ্ছেন কারা?

সংশ্লিষ্ট একটি মহল বলছে, এই গডফাদাররা কখনোই শাস্তির মুখে পড়বেন না। আড়ালে আবডালে থেকেই মাদক ব্যবসায় মদদ নিয়ে যাবেন? সে প্রশ্নের জবাব সংশ্লিষ্ট কারও কাছেই মেলেনি। তবে জানা গেছে, গডফাদারদের তালিকা না হওয়ার কারণ।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের গোয়েন্দা শাখার উপপরিচালক পদর্মযাদার এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, আইন অনুযায়ী মাদক-সংক্রান্ত অপরাধ সংঘটনে যিনি অর্থ বিনিয়োগ করেন, সরবরাহ করেন বা সহযোগিতা করেন তিনি পৃষ্ঠপোষক বা গডফাদার। অধিকাংশ সময় দেখা যায়, এ ধরনের ব্যক্তির কোনো না কোনো রাজনীতিক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। কেউ কেউ আবার এলাকার জনপ্রতিনিধিও। যাদের সহযোগিতায় মাদক দূর করার কথা তারা জড়িয়ে গেলে তখন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার জন্য পরিস্থিতি অনুকূলে থাকে না।

খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, গত চার বছরে মাদক সংশ্লিষ্ট বেশ কিছু তালিকা হলেও মাদক গডফাদারদের কোনো তালিকা হয়নি। থানা পুলিশে বা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরেও তাদের নামে কোনো মামলা বা আদালতে দাঁড়াতে হয়নি।

যদিও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮-এর ৪০ ধারায় বলা রয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি কোনো মাদকদ্রব্য অপরাধ সংঘটনে অর্থ বিনিয়োগ করিলে অথবা অর্থ সরবরাহ করিলে অথবা সহযোগিতা প্রদান করিলে অথবা পৃষ্ঠপোষকতা করিলে তিনি সংশ্লিষ্ট ধারায় নির্ধারিত দণ্ডের অনুরূপ দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’

একই আইনে ৪২ ধারায় বলা আছে, ‘সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অন্যূন ২ (দুই) বৎসর, অনূর্ধ্ব ১০ (দশ) বৎসর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন এবং অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ উমর ফারুক কালবেলাকে বলেন, পৃষ্ঠপোষকদের না ধরতে পারলে মাদক ব্যবসা বন্ধ করা কঠিন। হাজারো কোটি টাকার এই কারবার অবশ্যই চুনোপুঁটি দিয়ে হয় না। পেছনে থাকে রাঘব বোয়াল। তাদের তালিকাভুক্ত করে আইনেও আওতায় না আনলে। মাদক ব্যবসা কমবে না।