ফিরে এসো ধর্মে, সত্যে ও যুক্তিতে

নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে আততায়ীর গুলিতে অর্ধশতাধিক নিরীহ মানুষের জীবন গেল। একজন বর্ণবাদী মুসলিমবিদ্বেষী উগ্র মানুষ মুসলমানদের ওপর হামলে পড়েছিল। এর আগে মিয়ানমারের উগ্রবাদী বৌদ্ধ এবং সে দেশের সেনারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নিজ দেশের রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর। তারা হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করে।

তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। বহু রোহিঙ্গা নারী ধর্ষণের শিকার হয়। জীবন বাঁচাতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে আসে প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশে। আর সবশেষে মর্মান্তিক বোমা হামলা হল শ্রীলংকায়। প্রথমে শ্রীলংকার একটি উগ্রবাদী ইসলামী দলকে দায়ী করা হয়েছিল।

পরে আইএস নিজস্ব অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে এ হামলার দায় স্বীকার করেছে। ২৮ এপ্রিল ক্যালিফোর্নিয়ার এক ইহুদি উপাসনালয়ে গুলি চালায় ১৯ বছর বয়সী খ্রিস্টান তরুণ আর্নেস্ট। এতে এক নারী নিহত হন আর আহত হন কয়েকজন।

আমরা যদি সাম্প্রতিক সময়ে ওপরের সন্ত্রাসী হামলার চরিত্র বিচার করি, তবে দেখব ধর্মের নামে উগ্রবাদীরা মানবতাবিরোধী অপরাধই ঘটিয়েছে। মিয়ানমারে বৌদ্ধ গোষ্ঠী এবং বৌদ্ধ ধর্মাশ্রয়ী সেনাবাহিনী আঘাত করেছে প্রধানত রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর। এ রোহিঙ্গা পীড়নে অন্তরে যে উদ্দেশ্যই থাকুক না কেন বাইরের প্রকাশটি ছিল ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা। ক্রাইস্টচার্চের হামলাকারী কট্টর বর্ণবাদী অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকটি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়েছে।

তাই মসজিদে নিরীহ মুসলমানদের অবলীলায় নির্বিচারে হত্যা করতে পেরেছে। এ ধারাবাহিকতাতেই আইএস নির্বিচারে মানুষ হত্যার তাণ্ডব চালাতে পেরেছে। এরা আক্রমণের জন্য ঠিক করেছিল খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসবের দিনটিকে। আর বেছে বেছে সবচেয়ে বেশি বোমা হামলা করেছে গির্জাগুলোতে।

এ হামলাকে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার মধ্যেই আটকে রাখা যেত- কিন্তু আইএসের জঙ্গিরা পাঁচ তারকা হোটেলেও বোমা হামলা করেছে। সেখানে অন্য ধর্মের মানুষের পাশাপাশি অনেক মুসলমানও আহত এবং নিহত হয়েছে। এর যুক্তি কী! আইএস কি মানুষকে পাঁচ তারকা হোটেলে থাকা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে?

আমরা যদি বিভিন্ন ধর্ম অধ্যয়ন করি এবং তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব চর্চা করি, তাহলে দেখব সব ধর্মই মানবতার কথা বলে। মানবধর্মই শেষ পর্যন্ত ধর্মীয় দর্শনে প্রধান জায়গা নিয়ে আছে। যে কোনো কারণেই মানুষ হত্যা সব ধর্মই গর্হিত অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে। অথচ ধর্মের কথা বলেই এসব উগ্রবাদী গুপ্তদল আত্মঘাতী হামলায় মানুষ হত্যা করছে।

ইসলামে নির্বিচারে মানুষ হত্যা বড় পাপাচার হিসেবে চিহ্নিত। তাই আত্মহত্যাকেও মহাপাপ বলা হয়েছে। ইসলামী উগ্রবাদীরা শুধু মানুষই হত্যা করেনি- বোমা বুকে নিয়ে নিজেরাও আত্মাহুতি দিচ্ছে। কোনোটিই ধর্মসমর্থিত নয়। অথচ বিশ্বজুড়ে এরা নিজেদের পরিচয় দিচ্ছে ইসলামী দল বলে, আর সবচেয়ে বড় ইসলামবিরোধী কাজ করে যাচ্ছে।

সুবিধাবাদী লোভী গোষ্ঠীর সবচেয়ে সুবিধার অস্ত্র ধর্ম। এর কারণ ধর্ম মানুষের জীবনে আধ্যাত্মিকতার বাইরেও একটি বড় সাংস্কৃতিক আচরণ। যুগ যুগ ধরে মানুষ পুরুষানুক্রমে যার যার ধর্মকে বহন করে, লালন করে। যারা তেমনভাবে ধর্মের বিধিনিষেধ মেনে চলেন না তাদেরও যদি নিজ ধর্ম পরিত্যাগ করে চলে আসতে বলা হয়, ভেতর থেকে তাদের মন সায় দেবে না। কারণ অবচেতনভাবে হলেও মানুষ তার সংস্কৃতিকে বহন করে।

অন্যদিকে ধার্মিক মানুষ তো নিজ ধর্মকে গভীরভাবে অনুসরণ করে চলে। মানুষের এ সরল ও আদর্শিক প্রবণতাকেই নানা ধর্মের বণিকরা ব্যবহার করে থাকে। তারা সতর্ক থাকে সাধারণ ধার্মিক মানুষ যাতে গভীরভাবে ধর্মকে জেনে এর সৌন্দর্য অনুভব করতে না পারে। তাদের এরা ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা করে ধার্মিকের পবিত্র জায়গা থেকে সরিয়ে ধর্মান্ধ বানিয়ে ফেলে।

মধ্যযুগে এমন ধারার পোপতন্ত্রের ভেতরে থেকে কিছু সংখ্যক ধর্মনেতা ধর্মের দোহাই দিয়ে বাণিজ্য করতে চেয়েছিল। ইসলামী সভ্যতায়ও রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়ার জন্য ধর্মের নাম ভাঙিয়ে অনেক সংঘাত হয়েছে। তবে বৌদ্ধ ধর্মের নেতাদের মধ্যে প্রাচীন ও মধ্য যুগে উগ্রবাদের প্রকাশ তেমনভাবে দেখা যায়নি।

ধর্মের নামে সংঘাত অনেকটা আধুনিককালের সুবিধাবাদী ধর্মবণিকদের মাধ্যমে শুরু হয়েছে। তারা সচেতনভাবে কিছুসংখ্যক মানুষকে ধর্মান্ধ ও জঙ্গি বানিয়েছে। ভারতে কিছুসংখ্যক ধর্ম ও রাজনৈতিক বণিক কোনো কোনো মানুষকে ধর্মান্ধ হিসেবে তৈরি করতে পেরেছে। গো-হত্যার ধুয়ো তুলে ভারতের ইতিহাসে আগেও ধর্মীয় সংঘাত হয়েছে; কিন্তু ধর্মবণিকদের সঙ্গে রাজনৈতিক বণিকরা যুক্ত হওয়ায় এখন কোথাও কোথাও এ ঘৃণ্য আচরণ মাত্রা ছাড়াচ্ছে। বিপন্ন হচ্ছে মানবতা।

বৌদ্ধধর্মের জন্মই তো ছিল মানুষের মুক্তির জন্য। খ্রিস্টপূর্ব ছয় শতকে সামন্ত রাজার ছেলে গৌতম বৈদিক ধর্মাচারী শাসক ও পুরোহিতরা ধর্মের নামে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পীড়নে বিপন্ন মানুষকে মুক্ত করতে সরল পথ খুঁজছিলেন। একসময় তার উপলব্ধি হল ধর্মের নামে নানা উপাচার এনে শোষণ করা হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। তাই তিনি অষ্টাঙ্গিক মার্গর মধ্য দিয়ে সৎ চিন্তা, সৎ কর্মের নানা সৎ আদর্শে একটি সরল দর্শন উপস্থিত করলেন।

শুধু মানুষের প্রতি নয়, সব জীবের প্রতি দয়া তার দর্শনের প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়াল। এমন অহিংস দর্শনে বেড়ে ওঠা বৌদ্ধগোষ্ঠী যখন মানবতার বক্ষ বিদীর্ণ করে লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে নির্যাতন করে, গণহত্যা চালায়, রোহিঙ্গা নারীকে লাঞ্ছিত করে, রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে পাশের দেশে ঠেলে পাঠায়, তখন গৌতম বুদ্ধের আদর্শই ভূলুণ্ঠিত হয়। যদি আদর্শচ্যুত এসব উগ্রবাদী বৌদ্ধ নিজ ধর্মকে গভীরভাবে অনুভব করতে পারত, আলিঙ্গন করতে পারত সত্যকে আর যুক্তি দিয়ে সবকিছু বিচার করতে পারত তবে এভাবে মানবতার অপমান করতে পারত না।

যদি শ্রীলংকায় বোমা হামলায় ধর্ম নির্বিশেষে এত মানুষ হত্যার দায় স্বীকারকারী আইএস নেতা বা অনুসারীদের প্রশ্ন করা হতো এমন হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে তারা কী অর্জন করতে পারলেন, কী জবাব দেবেন তারা? যদি যুক্তির কারণে ধরে নেই কোনো দেশ বা ধর্মাচারী গোষ্ঠী ইসলামের ক্ষতি করছে বা মুসলমানদের নিপীড়িত করছে, তাই ইসলাম ও মুসলমানদের রক্ষার দাবিদার হয়ে তারা প্রতিশোধ নেয়ার জন্য পাল্টা আঘাত হেনেছে তা হলেও একটি যুক্তি খুঁজে পাওয়া যেত।

কিন্তু জঙ্গিরা তো হামলা করছে সাধারণ মানুষের ওপর। যদি প্রশ্ন করা হয় শ্রীলংকার গির্জাগুলোর খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী নিরীহ মানুষ ইসলামের কী ক্ষতি করেছে যে ধর্মীয় উৎসবের দিন ওদের ওপর বোমা হামলা চালানো হল, এ হামলাকারীরা কী জবাব দেবেন? এই যে হোটেলে বোমা হামলা করে বহু মানুষকে আহত-নিহত করা হল, এখানে তো নানা ধর্মের মানুষই ছিল। মুসলমানও ছিল অনেকে। ছিল নিষ্পাপ শিশু। কী অপরাধে এদের হত্যা করা হল? নিরীহ মানুষ মেরে কী অর্জন করল হামলাকারীরা?

ক্যালিফোর্নিয়ার ইহুদি উপাসনালয়ে হামলাকারীর বয়ানে একটি তাৎপর্য খুঁজে পাওয়া যায়। বলেছে, ইতঃপূর্বের দুই হামলাকারী দ্বারা সে উদ্বুদ্ধ হয়েছে। মাস ছয়েক আগে ক্যালিফোর্নিয়ার আরেক ইহুদি উপাসনালয়ে বন্দুক হামলা করেছিল রবার্ট বোয়ার্স। আর ১৫ মার্চ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে হামলা করে মানুষ হত্যা করেছিল ব্রেনটন টরেন্ট। এদের অনুসরণ করতে গিয়ে অনেকটা খেলাচ্ছলেই যেন বন্দুক হামলা করে আর্নেস্ট। তাহলে বলা যায়, এসব হামলার পেছনে আসলে কোনো আদর্শ নেই।

রয়েছে ধর্মের নামে ঘৃণা ছড়ানো আর মানবতাকে বিপন্ন করা। এ কারণে এসব জঙ্গি ভাবধারার মানুষদের বলতে ইচ্ছে হয়, আপনারা যে জঘন্য মানবতাবিরোধী কার্যক্রম চালাচ্ছেন, এতে তো ধর্মেরই অনুমোদন নেই- বরঞ্চ সব ধর্মই এসব হত্যাকাণ্ডকে পাপকর্ম বলেই চিহ্নিত করেছে। আর তেমন গর্হিত কাজ যারা করে ইহকালে যেমন মানুষের ঘৃণা আর অভিসম্পাত পায় তেমনি ধর্মের বিধান অনুযায়ী পরকালে এর জন্য শাস্তি পেতে হবে। তবে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত মহান আল্লাহই নেবেন।

মানুষকে আঘাত করা- রক্তাক্ত করা কি কোনো সত্যের আদর্শ সমর্থন করবে? আর জঙ্গি মানসিকতার মানুষের কাছে প্রশ্ন থাকবে, আপনারা কি কোনো যুক্তি দিয়েই নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করাকে সমর্থন করতে পারবেন? তাহলে এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে আপনারা কী অর্জন করবেন? সব ধর্মের ধর্মীয় জঙ্গিবাদীদের কাছে প্রশ্ন থাকবে, আপনাদের একান্ত অনুসারী ছাড়া নিজ নিজ ধর্মের সাধারণ মানুষের কি আপনাদের প্রতি কোনো সমর্থন রয়েছে? মানুষের সমর্থন ছাড়া কোন গোষ্ঠী কবে লক্ষ্যে পৌঁছতে পেরেছে

? আপনাদের মাথায় কাঁঠাল রেখে হয়তো কোনো কোনো বড় শক্তি অস্ত্র বাণিজ্য করে টাকা কামাচ্ছে। আর আপনারা নিজেদের কবর নিজেরা খুঁড়ছেন। ধর্মের দৃষ্টিতে মহাপাপ কাজে জড়াচ্ছেন।

আমার খুব করুণা হয় জঙ্গির খাতায় নাম লেখানো সাধারণ তরুণদের দেখে। এদের কী করে যে মগজধোলাই করা হয় কে জানে। সাধারণ যুক্তিবুদ্ধির বোধ যেন আর থাকে না। অবলীলায় মানুষ খুন করছে। কেন আর কী অপরাধে খুন করছে এ প্রশ্নটি নিজেকেও করছে না।

হাসতে হাসতে জীবন দিয়ে দিচ্ছে বেহেশত লাভের আশায়। এদের গুরুদের নিহত হওয়ার খবর তেমন একটা পাওয়া যায় না। তাহলে গুরুদের কি বেহেশতের দরকার নেই? এসব তরুণকে যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে ভাবতে হবে। নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থ গভীরভাবে পাঠ করতে হবে। অন্যের মুখে ধর্মের ব্যাখ্যা শোনা নয়, নিজেকেই বুঝে নিতে হবে। গুরুদের সাপ্লাই করা জিহাদি বই আর ভিডিও দেখা নয়, প্রকৃত অর্থে যার যার ধর্মগ্রন্থ থেকে দীক্ষা নিতে হবে।

এককালে বাংলা ছিল বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মগোষ্ঠীর দেশ। মুসলমানরা বহিরাগত। অনেক পরে এসেছে এ দেশে। মুসলিম সুফি সাধকদের ধর্ম প্রচার বাংলার সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করেছিল। ব্রাহ্মণ রাজাদের হাতে অত্যাচারিত শূদ্র হিন্দুরা বেঁচে থাকার আশ্বাস পেয়েছিল সুফিদের খানকায় এসে। সুফিরা হিংসার বদলে মানবতার শিক্ষাই ছড়িয়ে দেন। এভাবেই বাংলায় দ্রুত ইসলাম বিস্তৃত হতে থাকে। মনে রাখতে হবে বাংলায় তলোয়ার দিয়ে ইসলাম প্রচারিত হয়নি- হয়েছে মানুষের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ ঘটিয়ে।

তাই আমরা বলব, বর্তমান সময়ে বিষবাষ্পের মতো ছড়িয়ে যাওয়া মানবতাবিরোধী জঙ্গিবাদ কোনো আইন দিয়ে আর দমননীতি প্রয়োগ করে নিশ্চিহ্ন করা যাবে না। সমাজে ধর্মের প্রকৃত ব্যাখ্যা আর মানবিকতার আদর্শ প্রচার করতে হবে। ধর্ম যে হিংসা নয়, মানুষের প্রতি ভালোবাসার কথা বলে সে সত্য প্রচার করতে হবে। অন্ধত্ব নয়, যুক্তি দিয়েই সব জটিল প্রশ্নের সমাধান করতে হবে।

ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়