ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর তিন কারণে সাময়িক স্থগিত

কালেরকন্ঠ ◑

আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর বিরোধিতা, বহির্বিশ্বে সমালোচিত হওয়ার আশঙ্কা এবং কিছু অবকাঠামোগত ও প্রশাসনিক কাজ এখনো বাকি থাকায় ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তরের পরিকল্পনা আপাতত স্থগিত করেছে সরকার। যদিও ভাসানচর ক্যাম্পের প্রশাসনিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন সংক্রান্ত কাজ শেষ করার প্রক্রিয়া চলমান আছে।

বাংলাদেশে আগত মিয়ানমারের প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা থেকে এক লাখ রোহিঙ্গাকে গত বছরের নভেম্বরের মধ্যে নোয়াখালীর ভাসানচরে স্থানান্তরের পরিকল্পনা করেছিল সরকার। অনেক দেশ প্রথম থেকেই এর বিরোধিতা করে আসছে। সরকারের ভাবনায় ছিল ভাসানচরে তুলনামূলক উন্নত বাসস্থান ও ভালো ব্যবস্থাপনা দেখাতে পারলে বিদেশিরা শেষ পর্যন্ত দ্বিমত করবে না। তবে সরকারের সেই ভাবনায় আপাতত ভাটা পড়েছে। এখন ঠিক কোন সময়ে এক লাখ রোহিঙ্গা স্থানান্তর করা হবে তার কোনো সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা নেই।
ভাসানচরে রোহিঙ্গা ক্যাম্প কার্যক্রমের মূল দায়িত্বে আছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়।

এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক অন্যান্য সংস্থার আপত্তির কারণে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের পরিকল্পনায় আপাতত বড় কোনো অগ্রগতি নেই। তবে পরিকল্পনা বাতিল করা হয়নি। তিনি জানান, এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকারি পরিকল্পনা অনুযায়ী ভাসানচর ক্যাম্পের সব কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। কিন্তু সেখানে বিদেশি সংস্থার প্রতিনিধিদের থাকা, খাওয়া ও নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো প্রকল্প পরিকল্পনার মধ্যে ছিল না। আন্তর্জাতিক কয়েকটি সংস্থার পক্ষ থেকে এসব বিষয় উত্থাপন করা হলে ভাসানচরে বিদেশি কর্মকর্তাদের থাকার উপযোগী বাসস্থান তৈরি, সামগ্রিক নিরাপত্তার জন্য একটি থানা গঠন এবং অন্যান্য প্রশাসনিক পদ সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া হয়। এসব বিষয় সময়সাপেক্ষ হওয়ায় পরিকল্পনাটি কিছুটা থমকে গেছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের অপর একটি সূত্র জানায়, ভাসানচর বিষয়ে বিদেশিদের বিরোধিতার মূল কারণ তাদের নিজেদের নিরাপত্তার ইস্যু।

তাঁর মতে, নিয়ম অনুযায়ী শরণার্থীরা যেখানে থাকে, বিদেশি সংস্থার প্রতিনিধিদের সেখানে যেতেই হয়। ভাসানচরে যাওয়া-আসা ও থাকার ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যবস্থাপনার দাবি রাখে, যা সেখানে এখনো অনুপস্থিত। তবে বিদেশি সংস্থাগুলো এ ক্ষেত্রে নিজেদের কথা না বলে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে তুলে ধরছে।

কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মাহবুবুর রহমান কালের কণ্ঠকে জানান, কমিশনের পক্ষ থেকে ২৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের যেসব সদস্য ভাসানচরে যেতে চায়, তাদের একটি তালিকা করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। তবে সরকার ভাসানচর বিষয়ে আপাতত ধীরে চলো নীতিতে আছে। ফলে তালিকা তৈরির কাজ আপাতত বন্ধ।

তিনি বলেন, ‘সরকার যখনই এ বিষয়ে নতুন করে উদ্যোগ নেবে তখনই তালিকা তৈরির কাজ শুরু করব। উল্লেখ্য, কমিশনের পক্ষ থেকে করা তালিকায় সাড়ে তিন হাজারের মতো রোহিঙ্গা স্বেচ্ছায় ভাসানচরে যেতে সম্মতি দিয়েছে।’
এদিকে চলতি বছরে রোহিঙ্গাদের জন্য প্রস্তাবিত যৌথ সাড়াদান পরিকল্পনায় (জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান—জেআরপি) জাতিসংঘের পক্ষ থেকে ভাসানচর ক্যাম্পকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর আগে দুইবার জেআরপিতে ভাসানচরকে বাদ রাখা হয়েছিল। জানা গেছে, এবারও প্রস্তাবিত জেআরপিতে ভাসানচরের জন্য আলাদা কোনো বাজেট রাখা হয়নি। তবে ভাসানচরের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার ওপর একটি সমীক্ষা পরিচালনার আগ্রহ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। এ বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব শাহ্্ কামাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তরের বিষয়ে কোনো পক্ষের সঙ্গে চূড়ান্ত কোনো আলোচনা হয়নি। বলতে পারেন আমরা এখনো আগের অবস্থানেই আছি।’

কক্সবাজার ও এর আশপাশের এলাকার স্থানীয় লোকজনের ওপর শরণার্থীদের চাপ কমাতে সরকার নিজস্ব অর্থায়নে নোয়াখালীর ভাসানচরে শরণার্থী সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ভরণ-পোষণের বড় অংশ বহনকারী আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আপত্তির কারণে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়া গত জানুয়ারি মাসে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিজ (আইসিজে) থেকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে পাওয়া রায়ে বাংলাদেশ সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। ফলে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের বিষয়টি নিয়ে কোনো সমালোচনা হোক, সরকার তা চাচ্ছে না। ফলে ধীরে চলো নীতিতেই এগোচ্ছে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের বিষয়টি।