মাতামুহুরী এখন চকরিয়া পেকুয়াবাসীর অভিশাপ!

 

 এম জাহেদ চৌধুরী, চকরিয়া-পেকুয়া •

দুই দশক পূর্বেও প্রচণ্ড খরস্রোতা আশির্বাদের মাতামুহুরী নদী ভরাট হয়ে এখন তীরবর্তী বাসিন্দাদের অভিশাপ হয়ে উঠেছে। সামান্য বৃষ্টি হলেই উজান থেকে নেমে আসা ঢলে প্লাবিত হচ্ছে ফসলি জমিসহ হাজার-হাজার বসতি। আবার এই নদীকে পুঁজি করেই একাধিক অসাধু সিন্ডিকেট অবৈধপন্থায় অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন করছে। এসব বালু বিক্রি করে তারা রাতারাতি বনে যাচ্ছেন লাখপতি। ফলে নদীশাসন বিঘিœত হওয়ার পাশাপাশি একদিকে সরকার হারাচ্ছে বিপুল অংকের রাজস্ব, অন্যদিকে দুর্দশা কাটছে না মাতামুহুরী এলাকাজুড়ে বসবাসকারীদের।

জানা গেছে, দুদশক পূর্বেও এ নদীর পানি ব্যবহারের মাধ্যমে ফসল ফলিয়ে চকরিয়া-পেকুয়ার মানুষ সংসারের অভাব দূর করতো। আশির্বাদ থেকে অভিশাপে রূপ নেয়া মাতামুহুরীকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে এগিয়ে এসেছে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)।

আরও জানা যায়, মাতামুহুরী কক্সবাজারের চকরিয়া-পেকুয়া হয়ে মিশেছে বঙ্গোপসাগরে। এই নদীতে অবাধে চলাচল করতো ছোট-বড় নৌযান। মূষলধারে বৃষ্টি হলেও গভীর মাতামুহুরী দিয়ে পানি সমুদ্রে চলে যাওয়ায় পাহাড়ি ঢলের চিন্তামুক্ত ছিল নদীর তীরবর্তী বাসিন্দারা। কিন্তু মাতামুহুরী কেন্দ্রিক কক্সবাজার ও বান্দরবানের পাহাড়গুলো থেকে অবাধে বৃক্ষরাজি কাটার পাশাপাশি শেকড়সহ উত্তোলন ও পাহাড় কেটে বা খনন করে পাথর ও মাটি-বালি আহরণের ফলে বৃষ্টির সাথে ভেসে আসা পলিমিশ্রিত বালুতে আলোচিত মাতামুহুরী নদীর তলদেশে জমে ভরাট হয়ে গেছে।

সরকার আসে সরকার যায়। প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে সম্ভাব্য প্রার্থীরা মাতামুহুরী নদীর সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়ে ভোট আদায় করলেও পরবর্তীতে ওই আশ্বাস বাস্তবে রূপ পায় না। ২০১৬ সালে তৎকালীন পানিসম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ আশ্বাস দেন মাতামুহুরী নদী খনন করে ভাঙন ও প্লাবন থেকে রক্ষা করা হবে চকরিয়ার বন্যা কবলিত বাসিন্দাদের। তাও বাস্তবে রূপ পায়নি এখনো।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৮ সালে কয়েক দফায় বরাদ্দ দেওয়া প্রায় ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে মাতামুহুরী সেতু পয়েন্ট থেকে ভাটি এলাকার কিছু অংশ ড্রেজিং শুরু হয়। ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত অপরিকল্পিত লোকদেখানো করা ড্রেজিংয়ের এখন কোন আলামতই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ড্রেজিংয়ের নামে বালু ব্যবসা করে কতিপয় ব্যক্তির পকেট ভারী হলেও নদী শাসনে কোন সুফল বয়ে আসেনি। কয়েকদফা পাহাড়ি ঢলের পরপরই বালি, মাটি বরাট হয়ে ফের পূর্বেকার চেয়ে অধিক ভরাট হয়ে গেছে নদী। এতে সরকারের ৭ কোটি টাকা জলে গেছে বলে অভিমত স্থানীয়দের।

এদিকে, ভরাট মাতামুহুরী নদী খনন না হওয়ায় আলীকদম, লামা, চকরিয়া ও পেকুয়ায় বর্ষা মৌসুমে অল্প বৃষ্টিতেই ভয়াবহ ঢলে প্লাবিত হয়ে ক্ষতির শিকার হয় হাজার-হাজার পরিবার। হুমকির মুখে রয়েছে আরো অসংখ্য আবাদি জমি ও স্থাপনা।

অন্যদিকে, ভরাট মাতামুহুরী নদীর বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে বালু উত্তোলন করে লাখপতি বনে যাচ্ছে একাধিক অসাধু ব্যক্তি। শ্রমিক দিয়ে বালু উত্তোলন ছাড়াও প্রকাশ্যে মেশিন বসিয়ে বালু তুলে বিক্রয় করছে ওই ব্যক্তিরা। মাঝে-মধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালালেও অসাধ্য বালু ব্যবসায়ীদের অবৈধ ব্যবসা থেমে নেই। তারা সরকারকে রাজস্ব না দিয়ে অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন করায় নদীর যত্রতত্র চোরাবালির সৃষ্টি হয়েছে। এ চোরাবালিতে আটকে প্রায়শই মারা যায় শিশুসহ নারী-পুরুষ। পুরো মাতামুহুরী নদী সরকারিভাবে প্রশাসনের নজরধারির আওতায় আনার পাশাপাশি নদী শাসনের জোর দাবি জানিয়েছেন কক্সবাজার ও বান্দরবানের চার উপজেলার ১২ লক্ষাধিক বাসিন্দা। মাতামুহুরী ছাড়াও এই নদীর সাথে একীভূত হওয়া অন্তত ২০টি ছড়া বা খাল ভরাট হয়ে বিপুল জমি সেচ সমস্যায় চাষাবাদ হচ্ছে না। জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ থেকে মুক্তি মিলছে না সংশ্লিষ্ট খালের নিকটবর্তী বাসিন্দাদের।

চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জেপি দেওয়ান বলেন, ‘মাতামুহুরী নদীর চকরিয়া অংশে খনন ও তীর রক্ষায় ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে উপজেলা পরিষদের মাসিক সভায় দীর্ঘদিন দাবি উঠে আসছে। এই দাবি রেজুলেশন আকারে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। এতে সরকারেরও নজর কেড়েছে। রাষ্ট্রীয় তৎপরতার কারণে মাতামুহুরী নদীর তীর রক্ষা ও ড্রেজিং করতে এগিয়ে এসেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সরকারের উন্নয়ন সহযোগী জাইকা। তারা ইতিমধ্যেই নদী শাসনকল্পে জরিপ শুরু করেছে।’

ইউএনও আরও বলেন, ‘আশা করছি জরিপ কাজ শেষ হলেই ২০২৪ সালের পর মাতামুহুরী নদীকে তার সেই হারানো যৌবনে ফিরিয়ে আনতে পরিকল্পিত ড্রেজিং ও তীর রক্ষার কাজ শুরু হবে।’

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী ড. তানজির সাইফ আহমেদ বলেন, ‘গত আগস্টে পাহাড়ি ঢলে রেকর্ড বন্যার সৃষ্টি হয় চকরিয়ায়। ওইসময় আমরা বিষয়টি সরকারের মাধ্যমে জাইকাকে অবহিত করি। জাইকা স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বন্যার উৎপত্তিস্থল থেকে শুরু করে পুরো প্লাবিত এলাকা অবলোকন করে একটি ধারণা নেন। এ নিয়ে জাইকার সাথে ঢাকা ও কক্সবাজারে একাধিকবার আলোচনা হয়েছে আমাদের সাথে।’

তিনি আরও বলেন, ‘জাইকা প্রকল্প প্রণয়নপূর্বক নদী শাসন বাস্তবায়নে ইতিমধ্যেই জরিপ শুরু করেছে। জরিপ শেষে ২০২৫ সালের শুরু থেকে নদীর ড্রেজিং ও তীররক্ষার কাজ শুরু হবে।’

চকরিয়া-পেকুয়া আসনের সংসদ সদস্য জাফর আলম দৈনিক পূর্বকোণকে বলেন, ‘মাতামুহুরীর সমস্যা আমার নজরে রয়েছে। আমি বিভিন্ন প্লাটফর্মে পাহাড়ি ঢল থেকে চকরিয়া-পেকুয়াবাসীকে রক্ষা করতে দাবি জানিয়েছি। এরই প্রেক্ষিতে সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়ায় এগিয়ে এসেছে জাইকা। আশা করছি জরিপ শেষ হলেই এই নদীর তীর রক্ষা বাঁধ ও ড্রেজিং শুরু হবে।’