রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আর মাদ্রাসা বাড়ানো যাবে না, ১৯ নির্দেশনা

নাজিম মুহাম্মদ •

রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে মাদ্রাসা নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছে একাধিক গ্রুপ। এছাড়া মাদ্রাসাগুলোকে কেন্দ্র করে ঘটছে খুনের ঘটনাসহ নানা ধরনের অপরাধ।

উখিয়া এবং টেকনাফে অবস্থিত ৩৪টি ক্যাম্পে গড়ে ওঠা মাদ্রাসাগুলো নিয়ন্ত্রণে নিতে মরিয়া সশস্ত্র গ্রুপ আরকান সলভেশন আর্মি (আরসা)। নৈরাজ্যকর এমন পরিস্থিতিতে ক্যাম্পগুলোতে নতুন করে আর মাদ্রাসা তৈরি না করাসহ ১৯টি নির্দেশনা দিয়েছেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার।

২০২১ সালের ১৩ ডিসেম্বর অতিরিক্ত শরণার্থী কমিশনার শামসুদ দৌজা স্বাক্ষরিত লিখিত নির্দেশনা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত সংশ্লিষ্ট সকল প্রতিষ্ঠানের কাছে ইতিমধ্যে পাঠানো হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যাঙের ছাতার মতো রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গড়ে উঠছে মাদ্রাসা। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের ভাষায় এসব মাদ্রাসাকে স্থানীয়ভাবে বলা হয় লার্নিং সেন্টার। যার যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে মাদ্রাসা তৈরি করছে। অনেকে নিজের ঘরে গড়ে তুলেছে ছোটখাটো মাদ্রাসা। যেগুলোকে হোম বেইজড লার্নিং সেন্টার বলা হচ্ছে। একজন শিক্ষক এক ক্যাম্প থেকে আরেক ক্যাম্পে গিয়ে একাধিক মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করছে। ক্যাম্পে থাকা মাদ্রাসাগুলো কারা তৈরি করছে, অর্থের যোগান কিভাবে হচ্ছে, সেখানে কারা শিক্ষকতা করছে, কি পড়ানো হচ্ছে সব তথ্য রোহিঙ্গা শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ে জমা দিতে হবে।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী ৩৪টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মাদ্রাসার সংখ্যা পাঁচ হাজার ৪৯৫টি। সে হিসাবে প্রতি ক্যাম্পে প্রায় ১৬২টি মাদ্রাসা রয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, মাদ্রাসার সংখ্যা দ্বিগুণ। ক্যাম্পে লার্নিং সেন্টার বা মাদ্রাসার সংখ্যা কয়টি তা অনেকটা ধোঁয়াশার মধ্যেই আছে। ২০২১ সালের ২২ অক্টোবর ১৮ নম্বর ময়নারঘোনা ক্যাম্পে ‘দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল ইসলামিয়া মাদ্রাসায়’ গুলিবর্ষণ ও ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ছয়জনকে হত্যা করা হয়। সেই সময় মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা দীন মোহাম্মদ বলেছিল, ইসলামিক মাহাস নামে একটি সংগঠন মাদ্রাসাটির নিয়ন্ত্রক। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনসহ বিভিন্ন স্বার্থ রক্ষার ব্যাপারে সংগঠনটি কাজ করে। আরকান সলভেশন আর্মি (আরসা) মাদ্রাসাটি নিয়ন্ত্রণে নিতে চেয়েছিল।

আরসার চারটি উপ-শাখা রয়েছে। এরমধ্যে ‘উলামা কাউন্সিল’ গুরুত্বপূর্ণ একটি শাখা। উলামা কাউন্সিল মূলত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অভ্যন্তরে থাকা মাদ্রাসাগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখার কাজ করে।

১৯ নির্দেশনা : ক্যাম্পের অভ্যন্তরে থাকা মাদ্রাসাগুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে ১৯টি নির্দেশনা দিয়েছেন শরণার্থী ও প্রত্যাবাসন কমিশনার। তা হলো-অনুমোদিত লার্নিং সেন্টারের সংখ্যা এবং সেখানে ব্যবহারের জন্য অনুমোদিত জিনিসপত্রের তালিকা শরণার্থী প্রত্যাবাসন অফিসে পাঠাতে হবে।

শিক্ষক এবং রোহিঙ্গা কমিউনিটির যারা লার্নিং সেন্টারের সাথে সম্পৃক্ত তাদেরকে পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত প্রতি মাসে দশ হাজার টাকার বেশি প্রণোদনা দেওয়া যাবে না। লার্নিং সেন্টারগুলো শুধুমাত্র শিক্ষামূলক কার্যক্রমের জন্য ব্যবহৃত হবে। একজন শিক্ষক একটির বেশি লার্নিং সেন্টারে শিক্ষাদান করতে পারবেন না এবং নিজ ক্যাম্পের বাইরে অন্য ক্যাম্পে শিক্ষকতা করতে পারবেন না। একজন ছাত্র/ছাত্রী একটির বেশি লার্নিং সেন্টারে তালিকাভুক্ত হতে পারবে না।

বার্মিজ ভাষার প্রশিক্ষক হিসাবে ঊর্ধ্বতন কোন পদবি থাকবে না। ক্যাম্প ফোকালদের (মাদ্রাসা পরিচালনকারীদের) বিস্তারিত তথ্য শরণার্থী প্রত্যাবাসন অফিসে জমা দিতে হবে। মাদ্রাসায় ভর্তি হতে অন্তত পাঁচ বছর বয়স হতে হবে। ঘরে ঘরে শিক্ষাকেন্দ্র থাকবে না। নিজেদের ইচ্ছেমতো মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটি বিলুপ্ত হবে। শরণার্থী প্রত্যাবাসন অফিসের পরামর্শ অনুযায়ী নতুন কমিটি গঠন করতে হবে। ব্যক্তিগত মাদ্রাসা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। বর্তমানে থাকা মাদ্রাসাগুলোতে এমসিপি (মিয়ানমার ক্যারিকুলাম পাইলট) কার্যক্রম পরিচালিত হবে।

মাদ্রাসার সংখ্যা বাড়ানো যাবে না। মাদ্রাসায় অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীদের মিয়ানমারের সংস্কৃতি সম্পর্কে অবগত করা প্রয়োজন।

তারা যেন স্পষ্টভাবে বুঝতে পারে তারা মিয়ানমার জাতি এবং তাদের জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত, তাদের বেশভূষা এবং তাদের স্বতন্ত্র জীবন ধারার সংস্কৃতি বজায় রাখতে হবে। বাংলাদেশি সংস্কৃতির সাথে সম্পৃক্ত শিক্ষা পদ্ধতি মাদ্রাসাগুলোতে অনুসরণ করা যাবে না।

বাংলাদেশের শিক্ষকগণ লার্নিং সেন্টারের শিক্ষার্থীদের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করবে এবং প্রতিটি লার্নিং সেন্টারে বার্মিজ ভাষায় প্রকাশিত ছড়া, গল্পের বই এবং কবিতা প্রবর্তন করতে হবে।